বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ থেকে কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অবস্থা কেমন এটা নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। আমি নিজে সংগঠনের একজন সদস্য তাই উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমাদের সমাজের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের নারীরা এখানে বক্তব্য রাখেন।
নিচে তাদের কয়েকজনের কথা তুলে ধরছি :
রহিমা (শেখেরটেক) বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমাদের নারী হিসেবে মূল্যায়ন করেনা। অসুস্থ হলে ছুটি পাইনা। স্থায়ী গৃহকর্মীদের উপর অত্যাচার বেশি হয়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে, মাথা নত না করলে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। নারী পাচারের অপবাদ দেয়। সিসি ক্যামেরা চেক করতে বলাতে শুনতে হয়, কোন সংগঠনের সাথে জড়িত আছি কিনা? গার্মেন্টসে সুপারভাইজাররা যখন তখন শরীরে হাত দেয়।
রেহানা আক্তার (গাজীপুর, টংগী শাখা), ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত মালিক বেতন দেয়না। কু প্রস্তাব দেয়। ঈদের পরে ফিরে এসে পুলিশের কাছে অভিযোগ করাতে টার্গেট করে রাখে। পরে ছাটাই করে দেয়। ইউনিক ডিজাইনে ৩৪/৩৫ বছরেই বলে দুর্বল। কাজ করতে পারবেনা। আমি কেন এত কম বয়সে দুর্বল হলাম? থাকা খাওয়া ঠিকমতো হয়না বলেই। অল্প বয়সে কাজ করতে আসি, যতটুকু ক্যালরি ক্ষয় হয়, তা যেন পূরণের ব্যবস্থা করা হয়। ২০ বছরেই যেন ৪০ বছররের অজুহাতে ছাটাই না করা হয়।
শাহীনা বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারের হেমায়েতপুর নেয়া হলে, বেশি ডিউটি করতে হয়। স্কুল, হাসপাতাল নেই। সেখান থেকে মেডিকেল নিতেই রোগী মারা যায়।
মঞ্জু আরা বলেন, হাজারীবাগ থেকে যারা গেছে তাদের আইডি কার্ড, বেতন বই নেই। অনেককে বের করে দিয়েছে। তারা মামলা করেছে।
হোমায়রা বেগম বলেন, আমরা যারা শ্রম দেই, মালিকরা তাদের অতি নিম্নশ্রেণী মনে করেন। আমরা সমমর্যাদার অধিকার চাই। সন্তানের লেখাপড়ার নিশ্চয়তা চাই। এক কাজের স্থানে ৪ কাজ করায়। অধিকারের কথা বললে সরকারের কাছে যেতে বলেন।
ফাতেমা (সাভার) গার্মেন্টস শ্রমিক। বেতন বৃদ্ধি করলেও কাজের চাপ অত্যাধিক। কাজের জন্য ৫০০/১০০০টাকা ঘুষ নেয়। কাজের চাপে পেশাব চেপে রাখতে হয়। টয়লেটে যেতে দেয়না। যাদের চেহারা সুরত ভালো, হাসি ঠাট্টা করতে পারে তাদের নানা সুযোগ সুবিধা দেয়। আর যারা তেমনটি পারেনা তাদেরকে বিপদ আপদ না দেখে ছাটাই করে দেয়। আত্মীয় মারা গেলেও গ্রামে যেতে দেয়না। ঘুষ নেয়া বন্ধ করতে হবে।
কল্পনা বলেন, গার্মেন্টসে ছিলাম। নরপিশাচদের অত্যাচারের জন্য কাজ করতে পারিনি। পরে অনন্ত সোয়েটারে কাজ নিলে সেখানে তারা অভিযোগ দেয়। অনেক বেতন পেতাম। বাবার মৃত্যুতে গ্রামে গেলে, ১দিনে ছাটাই করে দেয়। নেতাদের কাছে যেতে বলে যে, তারাই ইপিজেড চালায়। ২০০৭ এর ঘটনা। এরপর বাসা বাড়ি কাজ নেই। সেখানেও বঞ্চিত হই। পরে ঢালাইয়ের কাজ নেই। এক্সিডেন্টে শরীরে ২২টি সেলাই নিয়ে ২০ কেজি ওজনের ঢালাই নিয়ে উপরে উঠি। খুব কষ্ট হয়। পুরুষের সমান কাজ করেও দিনে ২৫০ টাকা, রাতে ৪৫০টাকা পাই। পুরুষরা পায় ১০০০/১২০০টাকা।
প্রতিবাদ করতে গেলে বলে, ইশ মহিলা হইয়া আইছ, কী কাম করতে পারো? তখন চুপ হয়ে যাই।
রেণু আক্তার বলেন, বয়স বেশি, হাতে ব্যাথা, রূপসী-সুন্দরী নই বলে সপ্তাহে ১ দিন কাজ পাই। চট্টগ্রামের ফেনি শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে ছিনতাইকারীর কবলে পরে হাত ভাংগে। তিনি আরও বলেন, আমার ৪২ বছর বয়সে বাসে উঠলে গায়ে পিঠে হাত দেয়। তাহলে অল্প বয়েসীদের কী করে? জরিপ হওয়া দরকার। মহিলা সীটে পুরুষ বসলে ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এই আইনটি বাস্তবায়ন করতে মাননীয় সংসদ সদস্য শামসুন্নাহার ভুঁইয়াকে বিষয়টি সংসদে তোলার অনুরোধ জানান।
ফরিদা খাতুন (মাদারটেক) নির্মাণ শ্রমিক। পুরুষ শ্রমিকদের যেখানে ৬০০/৭০০টাকা মজুরী সেখানে আমরা পাই ৩০০টাকা। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারিনা। একদিন মরতে হবে তাই আল্লাহ খোদার নাম নেই। কিন্তু বোরকা পরা থাকলে, মুখ না দেখালে কাজ পাইনা। আমরা সমমজুরী চাই। সম্মান চাই।
জালো বেগম (কিশোরগঞ্জ)বলেন, আমরা খাবার পাইনা, মজুরী পাইনা।
সেলিনা আক্তার(গাজীপুর) সিকিউরিটি এসিস্ট্যান্ট, মূল বেতন পাইনা। নিয়োগ পত্র দেয়া হলেও বাস্তবতার সাথে মিল নেই। অন্তঃসত্ত্বা হবার ৪ মাস পরে স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়। মামলা দিলে খালাস হয়ে যায়। সন্তান নিয়ে কষ্ট করে চলি। প্রতিবাদ করে যৌন হয়রানি থেকে রেহাই পাই।
তাসলিমা খাতুন (নাটোর) ১২ বছরে গার্মেন্টসে কাজ নেই। মাসের ১০ তারিখ রাতে বেতন দিতো। রাগ বেশি থাকায়, আন্দোলন করায় পিএম, জিএম মানতে চাইতোনা বলে চাকরি চলে যায়। যারা উপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারতো তারা কাজ ও বেতন বেশি পেতো। একদিন অপমানিত হয়ে ফিরে যাই। পরে রাজনীতিতে যুক্ত হই। ৫ বছর পরে সেখানে ফিরে গেলে যেই পিএম অপমান করেছিলেন তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আমি শ্রমিকদের কষ্ট বুঝতে পারি। আর তাই সেখানেই কাজ করে, তাদের পাশে দাড়াই। গার্মেন্টসে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়না। আমি অনেক উপরে উঠতে চাই।
সুরাইয়া আক্তার সেলিনা (বাগেরহাট)সহ সভাপতি, মাদারল্যান্ড গার্মেন্টস। দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে শেষ থানা। সিডর লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। চিকিৎসার অব্যবস্থা।
সালেহা ইসলাম শান্ত্বনা। মাদারল্যান্ড মিরপুর ডেকো গার্মেন্টস এ একটি যৌন হয়রানির অভিযোগ আসে, পল্লবী থানায় মামলা হয়। রাজমিস্ত্রী, সিকিউরিটি গার্ড দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হই। মাতৃত্বকালীন ছুটি পাইনা, বেতন-ভাতা এসব যেন আমাদের শামসুন্নাহার ভুঁইয়া আপা সংসদে তুলে ধরেন। চাকুরির চুক্তিপত্র, বেতন কাঠামো, নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড দিতে হবে। বিদেশিরা ভিজিটে আসলে ডে কেয়ার সেন্টার চালু করে। অন্য সময় বন্ধ থাকে। আত্মীয় পরিজন মারা গেলেও লাশ দেখতে দেয়না। মোবাইল সাথে রাখার অনুমতি চাই।
গার্মেন্টস কর্মীরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। তারা ধনীদের মতো পোশাক পড়েনা। তাহলে কেন হয়? এর জন্য পোশাককে দায়ী করা যায় কী?
শাহানা আক্তার শীলা বলেন, আগে মানুষ ছিলাম না। এখন আন্দোলনে এসে মনে হয় মানুষ হয়েছি। গার্মেন্টসের ২৫০ শ্রমিক একটি টয়লেট ব্যবহার করেন। তবে অন্য আরেকটি গার্মেন্টস এর সুব্যবস্থা রয়েছে।
আরও পড়ুন: রেলপথে বারবার দুর্ঘটনা: সর্ষের মধ্যেই ভুত
রেহানা বেগম বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলাম। অন্তঃসত্ত্বা হলে ৬ মাসের বেতন আটকে দেয়। প্রতিবাদ করে শ্রমিক ইউনিয়নের সহায়তায় ফেরত পাই। অন্যরা পায়না। হুজুরের কাছে মেয়ে পড়াতে দিলে হুজুরের ছেলে ছোট্ট মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে যায়। থানায় মামলা দিলে ১৬/১৭দিন পরে উজিরপুর থানায় পাই। কিন্তু মেয়েকে কিছু খাইয়ে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়। বাংলাদেশের কোন চিকিৎসা বাকি রাখিনি। এত খরচ হয় যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছিনা। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরেও কেন স্বাধীনভাবে, নিশ্চিতভাবে চলতে পারিনা? ৩০ বছর পর্যন্ত নারীরা দেশ চালায় তবুও কেন যৌতুকের জন্য গায়ে আগুন জ্বালিয়ে নারীকে হত্যা করা হয়??
আমরা উপরের লেখাগুলো পড়েই বুঝতে পারি দেশের শ্রমজীবী নারীরা কি অবস্থায় আছেন। একজন কর্মজীবী নারী ভাল না থাকার অর্থ তার পুরো বাংলাদেশ কষ্টে থাকা। আমরা চাই অবিলম্বে সরকার নারীদের এইসব কষ্টের কথা আমলে নিয়ে সেগুলো সমাধানের জন্য কাজ করবে।
জুয়েলা জেবুন্নেসা খান, লেখক, সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
ফেসবুক :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা