ড. ইকবাল হুসাইন : বিশ্বজুড়ে এক ত্রাসের নাম করোনারভাইরাস। গোটা বিশ্ব আজ বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। চীনের বাইরে বিস্তৃতির পর থেকে মাত্র ৭০ দিনে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে ৮৭ হাজারেরও বেশি। বিশ্বের অনেক কোলাহলপূর্ণ, বর্ণিল ও কর্মব্যস্ত নগরী রীতিমত ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। নিউইয়র্কের মত জাঁকালো নগরী আজ মৃত্যুপূরী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশগুলো কোভিড-১৯ এর উদ্ধত ফণাকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে মৃত্যুবরণ করেছে দুই হাজারের কাছাকাছি, মোট মৃত্যু প্রায় ১৫ হাজার। বাংলাদেশেও ভাইরাসটি তার আসল রূপ চেনাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া তত্ত্ব (উষ্ণতা ও আদ্রতা), অধিকাংশ মানুষের বিসিজি টিকা গ্রহণ, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ওযু-গোসল ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে অনেকে খুব আশাবাদী ছিলেন। ধর্মান্ধতার কারণেও অনেকে বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সুবিধা করতে পারবে না। সবই ক্রমশ ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ভাইরাসটি সনাক্ত হওয়ার প্রথম ৩০ দিনে বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা (২১৮ জন; গত ২৪ ঘন্টায় আরো ১১২ জন) বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রথম ৩০ দিনের থেকে বেশি! যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ৩০ দিনে সাতজন এবং ৬০ দিনে মাত্র ৭৪ জন কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হয়। যুক্তরাজ্যে প্রথম ৩০ দিনে ৩৬ জন, জার্মানিতে ৪৬ জন, ফ্রান্সে ১২ জন, স্পেনে ৮৪ জন এবং ভারতে মাত্র ০৩ জন রোগী সনাক্ত হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল ইটালি। সেখানে ৩০ দিনে ১১০০ রোগী সনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হারও ইটালিতেই সবথেকে বেশি (১২.২৫ শতাংশ)। প্রথম ৩০ দিনে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার ৯.১৭ শতাংশ।
উপর্যুক্ত তথ্যই বলে দিচ্ছে, করোনাভাইরাস থেকে সৃষ্ট কোভিড-১৯ বাংলাদেশের জন্য কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছেন। বাংলাদেশের মত জনবহুল এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এ ধরনের ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এমনিতেই বেশি। কয়েক লক্ষ পোশাক শ্রমিকের ‘ঢাকা-গ্রাম-ঢাকা’ যাতায়াত, ত্রাণের নামে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের সমাবেশ, তাবলিগ জামায়াতসহ মসজিদে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, কাঁচাবাজার ও মুদিদোকানে মানুষের ভীড় এ ঝুঁকিকে আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক এলাকায় এখনো চায়ের দোকান কিংবা গলির মোড়ে আড্ডা, সামান্য এমনকি বিনা প্রয়োজনে বাজারে যাওয়া ও বাইরে ঘোরাফেরা অব্যাহত আছে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক সরকার যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছে তা মেনে চলার ক্ষেত্রেও অনেকে উদাসীন। অথচ করোনাভাইরাস বিস্তারের মোক্ষম সময় (চতুর্থ স্তর) পার করছি আমরা। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র প্রতিটি পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতা না দেখালে আগামী দিনগুলো আমাদের জন্য বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে!
কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হওয়ার পর গত একমাসে আমাদের বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমদিকে পিপিই এবং পরীক্ষা-কিটের সঙ্কট থাকলেও সরকার ইতোমধ্যে এ সঙ্কট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। সঙ্কট মোকাবিলায় বেসরকারি পর্যায় থেকেও উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা করা হয়েছে। করোনাভাইরাস বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও জনসাধারণকে সচেতনা করা, সশস্ত্রবাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামানো, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা, এলাকাভেদে লকডাউন ইত্যাদি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজও মানুষকে আশান্বিত করেছে, সাহস যোগাচ্ছে। সর্বোপরি অসহায়, দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের পাশে যেভাবে মানুষ দাঁড়িয়েছে তা সত্যিই আশাব্যাঞ্জক। ব্যক্তি, সমিতি, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক কর্মী, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান যে যার সামর্থ্য মত মানুষকে সহায়তা করছেন। এমনকি অনেকে বেওয়ারিশ প্রাণিদের খাবার প্রদান করছেন। শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, জীবাণুনাশক ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমও করোনার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। সবার এই সম্মিলিত প্রচেষ্টাই আমাদের বিজয়ের মূলমন্ত্র।
তবে আমাদের অনেক দুর্বলতাও রয়েছে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়া, বিনা চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর একাধিক অভিযোগ উঠেছে। কভিড-১৯ নয়, সাধারণ বা জটিল রোগীরাও চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন। কথিত অনেক ‘আন্তর্জাতিক মানের’ প্রাইভেট হাসপাতাল ভয়ে কুঁচকে গেছে। এরূপ একটি পরিস্থিতিতে সেবা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই! বৈশ্বিক এ মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাকর্মীরা রীতিমত বীরযোদ্ধার মত লড়াই করে চলেছেন। আমাদের দেশে কোনো কোনো ডাক্তারের বিরুদ্ধে পালিয়ে থাকার অভিযোগ আছে। দুর্যোগ অনেকের জন্য ‘সুযোগ’ সৃষ্টি করে দেয়। ইতোমধ্যে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ আত্মসাতের খবর প্রচারিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারি সত্বেও বিশাল অঙ্কের প্রণোদনা প্যাকেজের সৎ, সুষ্ঠু এবং যথাযথ ব্যবহার নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় আছে। নিবিড় মনিটরিং না থাকলে এখান থেকে অনেকে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হবেন।
আমাদের দুর্বলতার আরো একটি বড় দিক এই দেশের কিছু যুক্তিহীন, ধর্মান্থ ও প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ। এদের অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। অনেকে আবার ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে উত্তেজনা ছড়ায়। সৌদি আরব, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে কোভিড-১৯ রোগী সনাক্ত হওয়ার পরপরই মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করেছে। অতি উৎসাহী মুসল্লিদের ঠেকাতে মসজিদ চত্তরে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। পাকিস্তানে জুমা’র দিনে বেলা ১২টা থেকে ০৩টা পর্যন্ত মসজিদ এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি করা হচ্ছে। দেরিতে হলেও্ বাংলাদেশ সরকার যখন এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তখন কতিপয় আলেমসহ ধর্মান্ধ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের অনেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। দলনিরপেক্ষ এবং স্বনামধন্য আলেমদের মাধ্যমে এ বিষয়ে কার্যকর প্রচারণা চালানো উচিত। পবিত্র রমযান মাস সমাগত। মসজিদে খতম তারাবিহ পড়ার ব্যাপারে অনেকেই অতি উৎসাহ বোধ করেন। কিন্তু অবস্থার দৃশ্যমান উন্নতি না হলে কোনোভাবেই তারাবিহসহ মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায়ের অনুমতি প্রদান করা যাবে না। তাবলিগ জামায়াতের এক মুরুব্বি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘মসজিদে করোনা প্রবেশ করবে না’। বক্তব্যের অসারতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। বস্তুত করোনাভাইরাস ধনী-দরিদ্র, মুসলমান-অমুসলমান, ধার্মিক-নাস্তিক, সাদা-কালো, এশীয়-ইউরোপীয় কোনো জাত মানে না। সুতরাং সতর্কতার বিকল্প নেই। করোনা মোকাবিলায় ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট লকডাউন চলাকালে রাস্তায় কোনো লোক দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য অনেক দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী লকডাউন মানতে জনগণকে বাধ্য করছে। সমগ্র ভারতে টানা ২১ দিনের লকডাউনের মেয়াদ আরো বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা ‘সিথিল সময়’ পার করে ফেলেছি। সম্ভাব্য দুর্যোগ ও মহামারি রোধে আমাদের এলাকাভিত্তিক লকডাউন ব্যবস্থাকে আরো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সারাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যাপক প্রাণহানী প্রতিরোধে ছোটখাটো অনেক ক্ষয়ক্ষতি আমাদেরকে মেনে নিতে হবে।
উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি আরো জোরদার করতে হবে। পরীক্ষার পরিধি, চিকিৎসাকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা, রোগীর চিকিৎসার জন্য সাধারণ এবং আইসিইউ বেড, প্রয়োজনীয় ওষুধ-পথ্য প্রভৃতি বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। কোভিড-১৯ চিকিসায় বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও সম্পৃক্ত করা জরুরি। চীন ১০ দিনে, যুক্তরাজ্য ৯ দিনে বিপুলসংখ্যক বেডের হাসপাতাল নির্মাণ করেছে। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আমরাও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে পারি। ইতোমধ্যে দেশের ১৭টি জেলায় রোগী সনাক্ত হয়েছে। দেশের সবগুলো জেলায় এমনকি উপজেলায় বিপুলসংখ্যক রোগী সনাক্ত হবে এবং তাদের চিকিৎসা দিতে হবে- সে প্রস্তুতি আমাদের থাকা দরকার।
আমাদের সাধারণ মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজেদেরকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করা। নিরাপদে থাকার জন্য যত কষ্টই হোক ঘরে অবস্থান করতে হবে। পরিবারের সবাইকে ঘরে রাখতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে অন্যের সংস্পর্শ এড়িয়ে অন্তত তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখুন। অবশ্যই মাস্ক এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন এবং নিয়মিত বিরতিতে সাবান-পানি দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলুন। আপনি মনে করুন, আমরা একটা যুদ্ধে আছি। আমাদের শত্রু অদৃশ্য হলেও শক্তিশালী। কিন্তু আমরা ততোধিক শক্তিশালী এবং সদা সতর্ক ও সচেতন। আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতাই এ যুদ্ধে জয় লাভের একমাত্র উপায়। ইউরোপ পারেনি, আমেরিকা পারছে না, কিন্তু আমরা পারবো। করোনাভাইরাসের কাছে আমরা হারবো না। নিজের, পরিবারের, প্রতিবেশির, সমাজের সর্বোপরি দেশের জন্য আমাদেরকে জিততেই হবে।
# ড. ইকবাল হুসাইন, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা