প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া
যদি জার্মানীরা প্রথম এটম বোমার আবিষ্কার করতে পারতো তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বগ্রাসী ক্ষমতার ছন্দের পতন হতো। কিন্তু বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের অংকে ভুল কষার কারণে আনবিক বোমা প্রকল্পটি জার্মানির নাৎসি বাহিনী পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় বলে শোনা যায়। যদি সেই অংক কষাটি ভুল না হোত (অনেকের অভিমত উদ্দেশ্যমূলক ভুল) তাহলে জার্মানিরাই প্রথমে এটম বোমা বানাতো। তখন আমেরিকার উপরই ওই বোমা বিস্ফোরিত হতো। হিরোশিমা ও নাগাসাকি বেঁচে যেতো, লক্ষ লক্ষ নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ বেঁচে যেতো।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮:১৫ মিনিটে যখন হিরোশিমাবাসী কাজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল; শিশুরা, ছাত্ররা বিদ্যালয়ে যাবার জন্য পিতামাতার স্নেহ সান্নিধ্য পাচ্ছিল, সেই স্নিগ্ধ বাতাসের পরশে পরিবেশ সিঞ্চিত হচ্ছিল মনোমুগ্ধকর এহেন জনবহুল হিরোশিমা শহরের ব্যস্ত জনসাধারণের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিমান ‘এনোলা গে’ থেকে ‘লিটল বয়’ বোমাটি বিস্ফোরণ করা হল। হিরোশিমা শহরে চার লাখ লোকের বসবাস। হিরোশিমা ইন্ডস্ট্রি প্রমোশন হলের ৬শ’ মিটার উঁচুতে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। বোমাটির ধ্বংস ক্ষমতা ছিল বিশ হাজার টিএনটি এর সমান। ওই যুদ্ধ বিমানে তিনজন নাবিক ছিল। একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ নৌ-বাহিনীর ক্যাপ্টেন উইলিয়াম এস্ পারসন্স; বোমা নিক্ষেপকারী নাবিক মেজর টমাস ডবলু ফেরেবি ও পাইলট বা বিমান চালক কর্নেল পল টিবেটস্। বোমায় ৮০% উন্নত ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। ইউরেনিয়ামের ভর ছিল ৬৪ কিলোগ্রাম।
বিস্ফোরণের পর তাপমাত্রা তিন লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, দ্বিতীয় সেকেন্ডে সাত হাজার সাতশত ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, তৃতীয় সেকেন্ডে আঠার শত ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং পরে তা আস্তে আস্তে কমতে থাকে। বোমা বিস্ফোরণের পর ভয়ংকর মেঘ ও ফুটন্ত আগুনপুঞ্জ মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত নগরীকে গ্রাস করে ফেলে। কালো ধোঁয়াচ্ছন্ন এই মেঘের বিস্তৃতি ছিল দশ হাজার ফুট। শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা ভৌত ও অবকাঠামোসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হিরোশিমার কীট পতঙ্গ, পাখি ও প্রাণিজগত মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। শিশু, নারীসহ পঞ্চাশ হাজার মানুষ তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে! বোমা পরবর্তী তেজস্ক্রিয়তার কারণে কয়েক মাসে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার লোক প্রাণ হারায়। হাজার হাজার মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে।
আমি যখন নব্বইয়ের দশকে হিরোশিমা দেখতে জাপান যাই যখন হিরোশিমা মিউজিয়ামে রক্ষিত বোমা ফেলার দৃশ্য, মৃত্যুর মিছিল দেখি তখন আমি এতই বিচলিত হয়েছিলাম যে তা আজো আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না। একটা ভিডিওতে দেখলাম একটা শিশুর শরীর থেকে মাংস টুকরো টুকরো হয়ে ঝলসে পড়ছে। ওই দৃশ্য আজো আমার মনে ছাপ পড়ে আছে। সে যে মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্যগুলো নিষ্ঠুরতার নির্মম পরিহাস। যুদ্ধ হবে সৈন্যে সৈন্যে আর যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহৃত হলো নিরীহ শিশু কিশোর নরনারীর উপর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকির উপর দ্বিতীয় বোমা ‘ফ্যাটম্যান’ বিস্ফোরণ করা হল, আবারো হত্যাকাণ্ড। উপায়ান্তর না দেখে জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হল ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ ইউএসএস মিসৌরীর ডেকে (deck) আত্মসমর্পণ দলিলে জাপান সই করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হয়।
বোমা তৈরির ইতিহাস: জার্মানিদের ব্যর্থতা বনাম আমেরিকার সফলতা
বিংশ শতাব্দির ত্রিশের দশকে জার্মানিরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বিজ্ঞান গবেষণায় অনেক এগিয়ে। আইনস্টাইন, হাইজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানীরা জার্মান বংশোদ্ভূত। ওই শতাব্দীর প্রথম দশকের শুরু থেকেই পরমানুর উপর ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। পরমানুর গঠন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার আবিষ্কার ইত্যাদির ফলে বিজ্ঞান জগত উদ্ভাসিত, উদ্বেলিত, উদ্দীপিত। এহেন পরিস্থিতিতে ১৯৩২ সালে ইংরেজ পদার্থবিদ জেমস্ চেড্ওইক নিউট্রনের আবিষ্কার বিজ্ঞানের নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
বিজ্ঞানের এসব আবিষ্কারের পেছনে জার্মানি, আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশের বিজ্ঞানী এরনেষ্ট রাদারফোর্ড, হেনরি বেকারেল, মেরি কুরি, পিয়ারে কুরি, নীল বোহ্র সহ অনেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানীদের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৩২ সালেই প্রথম কৃত্রিম ফিউশান প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী মার্ক ওলিফেন্ট। একই সালে রাদারফোর্ডের সহকর্মী আর্নেস্টওয়ালটন ও জন কক্রফট এটমের বিভাজনের উপর সফল গবেষণা করেন। ১৯৩৪ সালেই এনরিকো ফার্মি ও তার সহকর্মীরা নিউক্লিয়াস এর সঙ্গে নিউট্রন আঘাতজনিত পরীক্ষায় (bombardment) সফল হলে বিজ্ঞান জগতের আবিষ্কারের নতুন উন্মেষ ঘটে। যা হোক ফার্মির এই আবিষ্কারের ওপর অনেক বিজ্ঞানী ভরসা রাখতে পারেননি।
১৯৩৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারিখে জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান ও ফ্রিজ স্ট্রাচম্যান ইউরেনিয়াম বিভাজন (Uranium Fission) এর গবেষণা ফল প্রকাশের জন্য জার্নাল (The Naturewiseschaften) এ পাঠান যা ১৯৩৯ সালের ৬ জানুয়ারি তারিখে প্রকাশিত হয়। জার্মানির পরীক্ষাগারে প্রকাশিত এই ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ে। তাত্তিক পদার্থ বিজ্ঞানী সুইডেনে অবস্থানরত মিসেস লাইস মাইটলার ও তার বন্ধু অটো ফ্রিশ বন্ধু অটো হান ও ফ্রিজ স্ট্রাচম্যানের আবিষ্কারের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন এবং এটার নামকরণ করেন নিউক্লিয়ার ফিশন যা ১৯৩৯ সালের ১১ ফেব্রুযারি “The Nature” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী প্রধান হিটলারের অত্যাচার নির্যাতন, নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে প্রাণে বাঁচার জন্য অনেক প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যে বিশ্ববিখ্যাত আইনস্টাইন অন্যতম। বিভিন্নভাবে যারা জার্মানি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবস্থান করলেও জার্মান বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। এক দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল অন্য দেশের বিজ্ঞানীদের অজানা থাকতো না। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে ও ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ইউরেনিয়াম ফিশন বা নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কারের খবর যখন জানাজানি হলো তখন ডেনিস পদার্থবিদ নীল বোহর তা যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের নজরে আনেন।
তাৎক্ষণিকভাবে ওই বছরের ২৬ জানুয়ারি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ওপর এনরিক ফার্মির নেতৃত্বে ৫ম ওয়াশিংটন সম্মেলন আহবান করা হয়। সম্মেলনের ফলাফলের সঙ্গে Experimental পদার্থবিজ্ঞানীরা একাত্মতা ঘোষণা করেন। বিশেষ করে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী এনরিক ফার্মি ও জন আর ডানিংহাম এ বিষয়ে আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেন।
একই সময়ে হাঙ্গেরি থেকে পলাতক পরমানু বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। নিউক্লিয়ার ফিশনের বিষয়টি নিয়ে তিনিও ১৯৩৪ সাল থেকে গবেষণা কর্ম চালিয়ে আসছিলেন। নিউট্রন বর্ষিত পরমানু বিভাজনের মাধ্যমে একটি নিউক্লিয়ার চেইন প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কাজ করতে বস্তুতঃপক্ষে প্রযুক্তির অভাবে ঐ কাজে সফল হতে সক্ষম হননি। ওয়ারিশংটনে ৫ম সম্মেলনের পর ঐ ব্যাপারে এনরিক ফার্মির সঙ্গে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা চালাবার জন্য তিনি একটি টিম গঠন করেন। উদ্দেশ্য নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর তৈরি করা। গবেষণায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে ইউরেনিয়াম ফিশনের ব্যাপারে অনেক মত পার্থক্য হলেও ফার্মি ও জিলার্ড ঐক্যমত পোষণ করেন যে উপযুক্ত নিউট্রন মডারেটর পাওয়া সম্ভব হলে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ফিশনের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার চেইন প্রক্রিয়া সম্ভব।
লিও জিলার্ড অভিমত দিলেন কার্বন উপযুক্ত মডারেটর হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর কার্বন ও ইউরেনিয়াম যা পারমাণবিক চুল্লি তৈরিতে সক্ষম হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের পক্ষে এত বড় চুল্লী বসানো সম্ভব নয়। তাই লিও জিলার্ড ইউরেনিয়াম সংগ্রহে অন্য পথ অবলম্বন করেন যা নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
এদিকে জার্মানের পদার্থবিজ্ঞানীরাও বসে নেই। যদিও বা সেই সময় জার্মানীতে পদার্থবিজ্ঞানীদের সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প, সীমাবদ্ধতার মাঝেও তারা নিউক্লিয়ার ফিশনের উপর গবেষণা কর্ম চালিয়ে যেতে লাগলেন। তবে এসব গবেষণা বিষয়ে নাজি শাসকদের খুব একটা উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর পর বিশ্বখ্যাত কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ জার্মানির বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের নিয়ে জার্মানীর সেনাবাহিনীর অধীনে একটি “ইউরেনিয়াম ক্লাব” গঠন করেন। ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের জন্য নিউক্লিয়ার শক্তির উদ্ঘাটন করা। আগেই বলেছি নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর তৈরিতে নিউট্রন গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উপযুক্ত মডারেটর এবং প্রচুর পরিমান ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন। মডারেটর হিসেবে ভারী পানি (D20) ও কার্বন এই দুটো পদার্থের মধ্যে হাইজেনবার্গ ভারী পানি হিসেবে এবং ফিসাইল বস্তু হিসেবে ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে প্লটোনিয়ামকেই বেছে নেন। হাইজেনবার্গ, আগেই বনেছি, ইউরেনিয়াম এর সংকট ভর গণনায় ভুল করেছিলেন। তার ধারণা হয়েছিল ফিসাইল বস্তু হিসেবে ইউরেনিয়াম সঠিক হবে না। তাই ইউরেনিয়ামের পরিবর্তে প্লটোনিয়ামকেই বেছে নেন তিনি।
উল্লেখ্য, গবেষণার ব্যাপারে আমেরিকার পদার্থবিজ্ঞানী এনরিক ফার্মি এবং জার্মানবিজ্ঞানী ওয়ান্টার বোথের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। লিও জিলার্ড এর অভিমত মডারেটর হিসেবে কার্বনকে ফার্মি গুরুত্ব দিয়েছিলেন অন্য দিকে বোথে ভারী পানির উপর জোর দেন। তাই হাইজেনবার্গ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর স্থাপনে প্লুটোনিয়াম ও ভারী পানির উপর জোর দেন। আর ভারী পানির মওজুত ছিল নরওয়েতে। ইতোমধ্যে নরওয়ে দখল করার সময় জার্মান বাহিনী বোমা মেরে ভারী পানি প্রকল্প এলাকা ধ্বংস করে দেয় যার জন্য নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের জন্য ভারী পানি প্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায় জার্মান বিজ্ঞানীদের জন্য। ভারী পানির জন্য শিল্প স্থাপনায় নাৎসী বাহিনীর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এমতাবস্থায় ১৯৪১ সালে নাৎসী বাহিনী নির্দেশ জারি করে যে আগামী ৯ মাসের মধ্যে নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি শেষ করতে হবে। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিশনের উপর গবেষণা করে নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও উপকরণ সংগ্রহ ইত্যাদি সব মিলে বিজ্ঞানীরা ব্যর্থ হলে নাৎসী বাহিনী শেষ পর্যন্ত নিউক্লিয়ার অস্ত্র বা এটম বোমা তৈরির প্রকল্পটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। যার জন্য জার্মানি আর এটম বোমা তৈরি করতে পারলো না। যুদ্ধের অন্যান্য অস্ত্র তৈরিতে জার্মানি বেশি মনোযোগ দিল এবং বিশ্বে এগিয়ে রইলো। এই প্রকল্পের ব্যাপারে বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গকে দায়ী করা হয়। বলা হয় তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন যাতে না হয় তজ্জন্য ইউরেনিয়ামের সংকট ভরের উপর অংক কষার ইচ্ছাকৃত ভুল করেছিলেন যাতে নাজি বাহিনী ঐ প্রকল্প পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য যে, হাইজেনবার্গ বাধ্য হয়ে ওই প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। বলা যেতে পারে মৃত্যু ভয়ে প্রকল্প প্রধান হয়েছিলেন বলে প্রবাদ আছে।
আইনস্টাইনের চিঠির ইতিহাস
এদিকে হাঙ্গেরি থেকে পলাতক ইহুদি বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড নিশ্চিত ভেবেছিলেন যে জার্মানিরা এটম বোমা তৈরির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর প্রকল্প তৈরির জন্য কি উপায় উদ্ভাবন করা যায়, তা ভাবতে ভাবতে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা তার মনে পড়ে যায়। তিনি জানতেন যে আইনস্টাইনের সঙ্গে বেলজিয়ামের রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বেলজিয়াম কঙ্গোতে ইউরেনিয়াম খনি বিদ্যমান। ওই ইউরেনিয়াম যাতে জার্মানিদের হাতে না পড়ে তজ্জন্য আইনস্টাইন যদি রাজ পরিবারকে অনুরোধ করে তাহলে বেলজিয়াম সরকার জার্মান বাহিনীকে ইউরেনিয়াম বিক্রি করবে না। এই চিন্তা করে আইনস্টাইনের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নিলেন। আইনস্টাইন তখন নিউইয়র্কের লং দ্বীপে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। তিনি তার হাঙ্গেরি থেকে পলাতক এক পদার্থবিদ বন্ধু ইউগেন উইগনারকে নিয়ে সুদীর্ঘপথ গাড়ি চালিয়ে ১২ই জুলাই ১৯৩৯ সাল তারিখে আইনস্টাইনের কাছে উপস্থিত হন। আইনস্টাইনকে যখন আনবিক বোমা তৈরিতে নিউক্লিয়ার চেইন প্রক্রিয়ার কথা জানালেন তখন আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় বলেছিলেন Daran habe ich gar Hichtgedacht (অর্থাৎ I did not even think about that)। বেলজিয়ামের রানির নিকট চিঠি লিখতে আইনস্টাইন অস্বীকৃতি জানালে ওখানে সাক্ষাৎকারে ঠিক হলো আমেরিকায় অবস্থানরত বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূতের নিকট ইউরেনিয়াম বিক্রির ব্যাপারে একটা চিঠি দিবেন। তাৎক্ষণিকভাবে সেই চিঠিটি আইনস্টাইন জার্মান ভাষায় বলেছিলেন এবং উইগনার লিখে নিয়েছিলেন এবং ওই চিঠিতে আইনস্টাইন সাক্ষর করেন। ওই বৈঠকেই ঠিক হলো নিউক্লিয়ার শক্তি, ইউরেনিয়াম সংগ্রহ, এটম বোমা তৈরি ইত্যাদির ব্যাপারে মার্কিন সরকারের সহযোগিতা চেয়ে আরেকটি চিঠি লিখা হোক। আইনস্টাইন এতে সম্মতি দেন। আরেকটা চিঠি লেখা হল যেটি জার্মান ভাষায় আইনস্টাইন বলেছিলেন।
সেই চিঠি লিও জিলার্ড কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান এবং তার ইংরেজি তর্জমা করে পরে আবার লিও জিলার্ড তার আরেক পদার্থবিদ বন্ধু এডওয়ার্ড টেলারকে সঙ্গে নিয়ে নিউইয়র্কের লং দ্বীপে আইনস্টাইনের নিকট আসেন। ওটি পড়ে আইনস্টাইন ওখানে সাক্ষর করেন। তারিখটা ছিল ১৯৩৯ সালের ২রা আগস্ট। সেই ঐতিহাসিক চিঠি ইংরেজিতে টাইপ করেছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একজন স্টেনোটাইপিস্ট মিস্ জেনেট কোটস্ওয়ার্থ। জার্মান ভাষা থেকে জিলার্ড যখন ইংরেজিতে অনুবাদের সময় প্রচণ্ড শক্তিশালী বোমার কথা উল্লেখ করছিলেন তখন সেই মুদ্রাক্ষরিক অবাক বিস্ময়ে বলে উঠেছিলেন “She wax sure she was working for a hut ”. অর্থাৎ তিনি নিশ্চিত হন যে তিনি একটা জটিল সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন।
যাই হোক আইনস্টাইনের সই হবার পর চিঠিটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নিকট কীভাবে সরাসরি পৌঁছানো যায় তা ভাবতে জিলার্ডের এক অস্ট্রিয়ান বন্ধু গুস্টান স্টলপারের কথা মনে পড়লো। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বললেন, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের এক পরম বন্ধু অর্থনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্টের বেসরকারী উপদেষ্টা আলেকজান্ডার সাক্স্ আছেন যার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের সরাসরি যোগাযোগ আছে। অষ্ট্রিয়ান বন্ধুর মাধ্যমে সাক্স্ এর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। তিনি চিঠিটা প্রেসিডেন্টকে পৌঁছিয়ে দিতে রাজি হন তবে শর্ত থাকে যে ওই চিঠিতে একজন নামীদামী লোকের সই থাকতে হবে। যখন বলা হলো যে আইনস্টাইন সই করবেন এতে তিনি খুবই উৎসাহিত হলেন। ওই চিঠির উপর ভিত্তি করে সাক্স্ও প্রেসিডেন্টকে নিউক্লিয়ার শক্তির ব্যবহারের উপর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে আরেকটা নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ পেতে সাক্স্ এর প্রায় দু’মাস সময় লেগেছিল। সাক্ষাতের দিনক্ষণ পেতে দেরি হবার কারণ হলো সবে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমেরিকাকে ইউরোপের ব্যাপারে নজর দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্টের ছিল বেশি ব্যস্ততা। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯ সালের অক্টোবরের ১১ তারিখে সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ নির্ধারিত হলো। সাক্ষাৎকারে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এড্উইন পা’ওয়াটশন, দুই সামরিক বিশেষজ্ঞ ও আর্মি লেফটন্যান্ট কর্নেল কেইথ এফ এডামশন ও নৌ কমান্ডার গিলবার্ট উপস্থিত ছিলেন। সে যাই হোক, প্রেসিডেন্ট আলাপ আলোচনাকে সংক্ষেপিত করে বলেন, “ Alex, what you are after is to see that the natis does not blow us up”.(আলেক্স, তুমি এখানে এসছো এই কারণে যে নাজি বাহিনী যাতে আমাদেরকে উড়িয়ে না দেয়।)
ইউরেনিয়াম সংগ্রহের বিষয় ছাড়াও আইনস্টাইন তার ওই ঐতিহাসিক চিঠিতে শুরুতে যে মূল অংশ লিখেছিলেন তার একটি উদ্বৃতি এখানে দিলাম। আইনস্টাইন লিখেছিলেন “Recent research on fission chain reactions utilizing uranium made probable that large amounts of power could be produced by a chain reaction and that, by harnessing this power, the construction of extremely powerful bombs was conceivable ”. অর্থাৎ ইউরেনিয়াম চেইন প্রক্রিয়া ব্যবহার করে প্রচুর পরিমান শক্তির উৎপাদন সম্ভব এবং সেই শক্তিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা তৈরি সম্ভব।
ওই চিঠির উপর কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আইনস্টাইনকে চিঠির একটা উত্তর দিয়েছিলেন। সেটি লিখা হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১৯ অক্টোবর। প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, “He set up a committee consisting of civilian and military representatives to study uranium.”. অর্থাৎ ইউরেনিয়ামের উপর জ্ঞানের জন্য তিনি নাগরিক ও সামরিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন।
মূলত এটা ছিল উপদেষ্টা কমিটি। এই কমিটির প্রধান ছিলেন ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ডস এর পরিচালক লাইমেন ডেমস্ ব্রিগস্। পরে এই ব্যুরোর নাম পরিবর্তন করে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস ও প্রযুক্তি’ রাখা হয়। ১৯৩৯ সালের অক্টোবর ২১ তারিখ এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ব্যুরো সদস্য এডামসন এটম বোমা তৈরীর ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন। বস্ততপক্ষে এই উপদেষ্টা কমিটি কাজে অগ্রসর হতে পারেনি। পরে ১৯৪০ সালে প্রকল্পটিকে ন্যাশনাল ডিফেন্স রিসার্চ কমিটির অধিভূক্ত করা হয়। ১৯৪১ সালে এটেম বোমা তৈরির বিষয়টি “ Office of the Scientific Research and Development (OSRD) ” তে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ১৯৪২ সালে এসে OSRD এর সাথে “দি আর্মি করপস্ অব ইঞ্জিনিয়ার্সকে” সম্পৃক্ত করা হয়। এইভাবে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে আনবিক বোমা তৈরির প্রকল্পটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রকল্পের আওতায় এনে প্রায় ৩১টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। ১৯৪১ সালে জাপান সেনারা পার্ল হারবার আক্রমন করলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার শুরুতে ফ্রান্স, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যৌথ শক্তি (Allied forces) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এদিকে একই সময়ে যুক্তরাজ্যেও নিউক্লিয়ার ফিশনের উপর বহু পদার্থবিজ্ঞানী গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে। জার্মান থেকে বিতাড়িত ইহুদি বিজ্ঞানী অটো ফ্রিশ ও রুডলফ্ পায়ার্লাস্ ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এর নিকট একটি স্মারকলিপি (Memorandum) প্রদান করেন যা ফ্রিশ-পায়ার্লাস্ মেমোরেনডাম নামে অভিহিত। এই স্মারকলিপিতে এটম বোমা তৈরিতে ফিসাইল বস্তুর সংকট ভর কত হতে পারে তা সঠিকভাবে নির্ণয়ের বিষয়টা উল্লিখিত ছিল। এছাড়া আনবিক মারণাস্ত্র কি রকম ধ্বংসকার্য চালাতে পারে, বিকিরণ রশ্মির প্রভাব ইত্যাদি সহ চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়। এই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকারী বিজ্ঞানীরা যুক্তরাজ্যে কর্মরত। ইতোমধ্যে যুদ্ধের দামামা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আগেই বলেছি আমেরকিা, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য নিজেদের মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ম্যানহাট্টন প্রকল্প অনুমোদন
ইতোমধ্যে নিউক্লিয়ার গবেষণার উপর কার্যক্রম প্রসার বিষয়ে আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে ১৯৪০ সালের ১৭ইং মার্চ এবং একই বছরের ২৫ শে এপ্রিল দু’টো চিঠি লিখেন। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে এটম বোমার উৎস হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যবহারের উপর যুক্তরাজ্যের ‘মাউদ’ (MAUD) কমিটি একটি রিপোর্ট তৈরি করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে প্রদান করে। ফ্রিশ-পায়ার্লস্ এর স্মারকলিপি, আইনস্টাইনের তিনটি চিঠি, মাউদ কমিটির রিপোর্ট পেয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একটি কার্যকরী পদক্ষেপের সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে “ম্যানহাট্টন প্রকল্প” এর সৃষ্টি হয়। ১৯৪২ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর তারিখে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ম্যানহাট্টন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেন। এই প্রকল্পের প্রধান ছিলেন ‘দি আর্মি করপস্ অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ এর প্রধান মেজর জেনারেল লেজলি গ্রোবস্। লস্ আলামস্ লেবরেটরিতে যেখানে আনবিক বোমার ডিজাইন করা হয় সেই লেবরেটরির প্রধান ছিলেন নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হাইমার। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অবস্থানে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। তার মধ্যে নিউমেক্সিকোর টেনেসসি এবং ওয়াশিংটন ও কানাডার বিভিন্ন স্থান অন্যতম। ১৯৪২-১৯৪৫ প্রায় ৪ (চার) বছর ধরে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আনবিক বোমা তৈরীতে অনেকটা নিশ্চিত হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
এক পর্যায়ে যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম তখন বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড আনবিক বোমা ব্যবহারে এবং ইহার ধ্বংযজ্ঞের ব্যাপারটি আন্দাজ করতে পেরে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে আনবিক বোমা ব্যবহারের প্রকাশ্য বিরোধিতা শুরু করলেন। তিনি তখন শিকাগো মেটিরিওলজিকেল ল্যাব এর প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। নাজি জার্মানির আগে আনবিক বোমা তৈরিতে যদিও বা জিলার্ড প্রবল উৎসাহী ছিলেন, তারপরও এর ব্যবহার নিয়ে বিরোধিতা করলেন। কিন্তু ততদিনে ম্যানহাট্টন প্রকল্পের তৈরি বোমা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। ১৯৪৫ সালের ২৫ শে জুলাই নিউমেক্সিকোর মরুভূমিতে ভোররাতে বিশ্বে সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরীক্ষা করা হলো।
বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা অবহিত হতে পেরে আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে ১৯৪৫ সালের ২৫ শে মার্চ তার চতুর্থ চিঠি লিখেন। এই চিঠিতে আইনস্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে বিজ্ঞানী লিও জিলার্ডের কথা শোনার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চিঠি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নিকট পৌঁছানো সম্ভব হয়নি কারণ ১৯৪৫ সালের এপ্রিল ১২ তারিখে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মৃত্যুবরণ করেন। এর পর পরই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ক্ষমতায় আসেন যখন বিশ্বযুদ্ধ তুঙ্গে। বলা হয় প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের যুদ্ধ সচিব হেনরি এল স্টিমসন ওই চিঠি পড়েও দেখেননি। আরো বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে এত বড় আনবিক প্রকল্প যার চিঠির প্রেক্ষিতে ম্যানহাট্টন প্রকল্প তৈরি হয় সেই প্রকল্পে আইনস্টাইনকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। বলা হয়েছে, “ He was denied a security clearance in 1940 became of his paeifist beliefs.”. অর্থাৎ আইনস্টাইনের শান্তি পিয়াসী মতবাদের কারণে তাকে নিরাপত্তা ছাড় দেয়া হয়নি।
অনেকের অভিমত এই আনবিক বোমা তৈরিতে আইনস্টাইন ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারটিকে তিন হাঙ্গেরিয়ান পদার্থবিদদের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করা হয়- “Hungarian Conspiracy”.। ওই তিনজন হাঙ্গেরিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী হলেন লিও জিলার্ড, ইউগেন উইগনার ও এডওয়ার্ড টেলার। তিনজনই হাঙ্গেরি থেকে আমেরিকায় পলাতক ইহুদি বিজ্ঞানী। ১৯৪৫ সালে ৬ আগস্ট হিরোশিমার বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা দেখে আইনস্টাইন দুঃখ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছিলেন বিশেষ করে ম্যানহাট্টন প্রকল্পে তার ভূমিকা নিয়ে বলেছিলেন- ‘Had I known that the Germans would not succed in developing an atomic bomb, I would have done nothing for the bomb’. অর্থাৎ আমি যদি জানতাম যে জার্মান এটম বোমা তৈরীতে সফল হবে না তাহলে এটম বোমা তৈরির ব্যাপারে আমি কিছুই করতাম না।
যা হোক এই বোমার বিষয়ে আমি আগেও অনেক লিখেছি, আমি বলেছি সবসময় আইনস্টাইনের ভুলের কারণেই বিশ্বে আনবিক বোমার সৃষ্টি হয়েছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে বিশ্ব আনবিক বোমা জগতে প্রবেশের অন্যতম কারণ ইহুদি পদার্থবিজ্ঞানীদের উপর জার্মান নাৎসি বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রোশ।
জাপানে আনবিক বোমা বিস্ফোরণের পর বিখ্যাত কোয়ান্টাম তত্ববিদ হাইজেনবার্গ মন্তব্য করেছিলেন “ Some dilett ante in America Who Knows Very Little about it has bluffed them. I don’t believe it has nothing to do with the Uronium” (এমন কি হিরোশীমায় এটম বোমা ধ্বংসের পরও জার্মানিরা বিশ্বাস করে নাই যে আমেরিকানরা জাপানে বোমা বর্ষণ করেছে।) জার্মানিরা এ ব্যাপারে আমেরিকানদের উপর কোনও আস্থাই রাখতে পারেনি।
আমেরিকার ইতিহাসে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লিখা চিঠিটি একটি খোদিত দলিল হিসেবে চিরকাল প্রতিভাত হবে। বিখ্যাত একজন শিক্ষাবিদ প্রফেসর ওয়ারেন বাফে ২০১৭ সালে তার কলম্বিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে বলেছেন “If you think about it, we are sitting here, in part, because of two Jewish immigrants who in 1939 in August signed the most important letter perhaps to the history of the United tates.”.(অর্থাৎ আমার প্রিয় ছাত্ররা যদি তোমরা যদি এটাকে নিয়ে ভাব যে, আমরা এখানে আংশিকভাবে বসে আছি কারণ ১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসে দুই ইহুদি অভিবাসী আমেরিকার ইতিহাসে হয়তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সই করেছিলেন।)
এই ম্যানহাট্টন প্রকল্পে দু’ধরনের বোমা তৈরি হয়। একটি হলো আপেক্ষিকভাবে বন্দুক টাইপ ফিশন অস্ত্র, আরেকটি অতীব জটিল ইম্প্লোশন টাইপ নিউক্লিয়ার অস্ত্র। হিরোশিমায় নিক্ষেপিত আনবিক অস্ত্রটি ছিল থিন ম্যান গান টাইপ (The Thin Man Gun type) যেটিতে U-235 ব্যবহৃত হয়েছিল। যার নাম দেয়া হয় লিটল বয়। আর নাগাসাকিতে ব্যবহৃত অস্ত্রের নাম ছিল ‘ফ্যাটম্যান’ যেটি ছিল ইমপ্লোশন টাইপ যেটিতে প্লুটোনিয়াম ব্যবহৃত হয়েছিল। আর নিউ মেক্সিকোর Alamogondo Bombing এবং Gunnery Range এ বোমাটি পরীক্ষা করা হয় (বিশ্বে প্রথম) তা ছিল Implosion Type.
উল্লেখ্য, ১৯৬৪ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট লিনডন বি জনসন পারমানবিক শক্তির উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করে বিল পাশ করেন। এর আগে যুদ্ধের পর পরই পারমাণবিক গবেষণার জন্য আমেরিকা আনবিক শক্তি কমিশন গঠন করে। এইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আনবিক বোমা তৈরি করে পরমাণু অস্ত্রতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ সনে ৪র্থ পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করে।
উল্লেখ্য যে, কালক্রমে ম্যানহাট্টন প্রকৌশলী দ্বারা পূর্ণতাপ্রাপ্ত দি নিউক্লিয়ার ফিশন প্রযুক্তি এ পর্যন্ত নিউক্লিয়ার রিখ্যাক্টর জেনারেটর ও অন্যান্য উদ্ভাবনী শক্তি, মেডিক্যাল শিক্ষায় MRI,রেডিয়েশন থেরাপি, বিভিন্ন ধরণের ক্যানসার গবেষণার ভিত্তি হয়ে উঠেছে।
আরো বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এ পর্যন্ত যত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হয়েছে সমস্ত অস্ত্রই কোবিড-১৯ এর কাছে নির্মমভাবে পরাস্ত হয়েছে। করোনাভাইরাস এতই শক্তিশালী। বিজ্ঞজনের অভিমত, আইনস্টাইন যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি না লিখতেন তাহলে আনবিক বোমা কখন তৈরি হতো, তা কে জানতো! তাই আমি বলেছি আমার প্রিয় বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ভুল করেছেন। বিশ্ববাসী ভুলের মাশুল দিচ্ছে, আরো দিবে। আগেই বলেছি আইনস্টাইন শান্তিবাদী। সেজন্যে তাকে ম্যানহাট্টন প্রকল্পের ধারে কাছেও যেতে দেয়া হয়নি। আইনস্টাইন যে শান্তিবাদী ছিলেন তার প্রমাণ হলো ১৯১৯ সালে ফরাসী ঔপন্যাসিক ও মানবহিতৈষী চিন্তাবিদ রোঁমা রোঁলা ইউরোপের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে “মানব মনের স্বাধীনতা সংক্রান্ত” দলিলে (La declaration pour I’independence de L’espirit)আইনস্টাইন এবং একই সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও স্বাক্ষর করেন। ম্যানহাট্টন প্রকল্পে আইনস্টাইনকে যদি সম্পৃক্ত করা হতো তাহলে হয়তো পুরো ব্যাপারটি অন্যদিকে মোড় নিতো। তারপরও বলি আইনস্টাইন আইনস্টানই।
লেখক সম্পর্কে: প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, একুশে পদকপ্রাপ্ত, বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, পিএইচএফ
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা