অনলাইন ডেস্ক
বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত মূল অংশের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার এবং উঠানামার পথসহ ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এই অংশে মোট ১৫টি র্যাম্পের মধ্যে ১৩টি র্যাম্প যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। ফলে ওইদিন থেকেই মোট ১৩টি জায়গা দিয়ে ওঠা বা নামা যাবে।
দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে তৈরি এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনের দিনক্ষণ ঘোষণা হতেই শুরু হয়েছে নানা অপপ্রচার। এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যার কোনো যুক্তি ও ভিত্তি নেই।
কেউ বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে বড়লোকের রাস্তা। কেউ বা হতাশা প্রকাশ করছেন, সেখানে মোটরসাইকেল কেন চলবে না? এতোদিন পর কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ আবার মতামত দিচ্ছেন বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়ক ‘খুব ভালো’, সেখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কোন প্রয়োজন নেই। এক্সপ্রেসওয়ের টোলের হার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার পরও কোনো কোনো গণমাধ্যম আবার ‘ভাইরাল’ হওয়ার বাসনায় পুরনো প্রস্তাবিত টোলের হার প্রচার করে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করার উদ্দেশ্য যাদের নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত প্রয়োজন তাদের জন্য। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী ট্রাকগুলো গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত যেন নির্বিঘেœ চলে যেতে পারে এই উদ্দেশ্যে এটি করা। পাশাপাশি নগরীর ভেতরে যারা দ্রুত যেতে চান, তারা ব্যবহার করবেন। তাদের জন্য বিমানবন্দর, ফার্মগেটসহ কয়েকটি ওঠানামার জায়গা রাখা হয়েছে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্দেশ্য
বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের মহাসড়কগুলো একটানা চলাচলের উপযোগী নয়। রয়েছে অসংখ্য মোড় আর হাটবাজার। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে দেশের কয়েকটি মহাসড়কে করা হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। এর প্রথমটি ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। এই এক্সপ্রেসওয়েটি মাটির ওপর। অন্যদিকে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েটি এলিভেটেড বা উড়াল পথ। এক্সপ্রেসওয়েতে সব ধরনের যানবাহন চলবে না, দ্রুতগতির যানবাহন চলবে। যানবাহন চলবে একটি নির্দিষ্ট গতিতে। যানবাহন এক্সপ্রেসওয়ের কোথাও থামবে না। থামতে হলে ব্যবহার করতে হবে নির্দিষ্ট লেন, যা মূল এক্সপ্রেসওয়ের বাইরে। একে বলা হচ্ছে র্যাম্প। সারা পথে গতি এটাই এই এক্সপ্রেসওয়ের বৈশিষ্ঠ্য। বিশেষ করে, গাজীপুর থেকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরগামী রপ্তানিমুখী পণ্যপরিবাহী গাড়ি যাতে ঢাকার জ্যামে আটকে না থেকে দ্রুত বন্দরে পৌঁছে যেতে পারে, সে জন্য বিজিএমইএ সহ রপ্তানি-ব্যবসায়ীরা এ ধরনের একটি এক্সপ্রেসওয়ের দাবি করেছিলেন। এক্সপ্রেসওয়ের সুবিধা নিতে যানবাহন কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করতে হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টোল।
ঢাকার বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশে চলাচলের যানবাহনগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করে টোল নির্ধারণ করেছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১৯শে আগস্ট সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই টোলের হার ঘোষণা করেন।
শ্রেণি-১: প্রাইভেটকার, ট্যাক্সি, জিপ, ‘স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল’, ১৬ সিটের কম মাইক্রোবাস এবং তিন টনের কম হালকা ট্রাকের ক্ষেত্রে টোল ৮০ টাকা।
শ্রেণি-২: ছয় চাকা পর্যন্ত মাঝারি ট্রাকের টোল ৩২০ টাকা।
শ্রেণি-৩: ছয় চাকার বেশি ট্রাকের জন্য টোল ৪০০ টাকা।
শ্রেণি-৪: ১৬ বা তার বেশি আসনের সব ধরনের বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬০ টাকা।
এক্সপ্রেসওয়ে বড়লোকদের জন্য প্রশ্ন কেন উঠলো ?
যাদের নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াত প্রয়োজন, তাদের জন্য এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করা হয়েছে। মূলত রপ্তানিমুখী ট্রাকগুলো গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নির্বিঘেœ চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে এটি তৈরি করা হয়েছে। যাতে দ্রুত এসব ট্রাক চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে যেতে পারে। পাশাপাশি ঢাকার ভেতরে দ্রুত চলাচল করতেও এই পথ ব্যবহার করার জন্য বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ওঠানামার মোট ৩১টি জায়গা রাখা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ওঠানামার জায়গা (র্যাম্প) মোট ১৫টি। শুরুতেই এর ১৩টি খুলে দেওয়া হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যেহেতু বাস চলবে, সেই বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬০ টাকা। যেকোনো স্বল্প-স্টপেজ বাস এই রুটে চলতে পারে। চাইলে কোনো বাস বিমানবন্দর থেকে সরাসরি ফার্মগেট/তেজগাঁও চলে আসতে পারে। বলাকা পরিবহনের মতো বেশ কয়েকটি বাস কোম্পানি এমন স্বল্প-স্টপেজ সার্ভিস দেয়। সাধারণ মানুষ এই বাসে করে এই রুটের সুবিধা নিতে পারবে। আবার চাইলে র্যাম্প ব্যবহার করে বাসগুলো সুবিধামতো স্টপেজেও থামাতে পারবে। একদিকে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে অন্যদিকে সাধারণ মানুষও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুযোগ সুবিধা পাবে।
যে কারণে মোটরসাইকেল চলবে না
দুর্ঘটনার ঝুঁকি শূন্যে নিয়ে আসতে উচ্চগতির যানবাহনের জন্য নির্ধারিত এই পথে স্বল্পগতির বাহন যেকোনো থ্রি হুইলারের চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোটরসাইকেলের মতো বাহনের চলাচল আপাতত নিষিদ্ধ করেছে সরকার। পদ্মা সেতুতেও কিছু সময়ের জন্য মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ ছিল। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল অনুমোদিত। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশেই এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও সবগুলো এক্সপ্রেসওয়েতেও স্কুটার এবং মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল চলবে না, এই নীতিটিই যেখানে সাধারণ হওয়ার কথা, সেখানে মোটরসাইকেল কেন চলবে না, এই প্রশ্নটি এনে সবকিছুকে উদ্দেশ্য মূল কাজকে বিতর্কিত করে তোলা হচ্ছে। একইভাবে পথচারীরাও কেন এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে না, এমন অবাস্তব প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ।
বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত কোনো যানজট নেই?
প্রকৌশলী অধ্যাপক শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন মন্তব্য করেছেন, বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সড়ক ‘খুব ভালো’, এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অপ্রয়োজনীয়। এ মুহূর্তে এটা কোনো কাজেই আসবে না। অনেকে আবার বলছেন, ফার্মগেটে গাড়িগুলো নামলে ফার্মগেটে আরো বেশি যানজট সৃষ্টি হবে। (অথচ অধ্যাপক শামসুল হক নিজেই এ প্রকল্পের একজন ডিজাইনার)
অথচ মাত্র কয়েকমাস আগেই দোসরা অক্টোবর ২০২২, দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদ- “রাজধানীর বনানী থেকে বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত ভয়াবহ যানজটে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ।”
আরো অসংখ্য সংবাদে এ রুটের যানজটের কথা বলা হয়েছে। বিজয় সরণীর মোড়ের যানজট থেকে শুরু করে মহাখালী, সৈনিক ক্লাব, কাকলী, নিকুঞ্জ ইত্যাদি এলাকার তীব্র যানজটের বিষয়টি বার বার গণমাধ্যমে এসেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র থেকে উত্তরাগামী যানবাহনগুলো সরাসরি চলে যেতে পারবে। ফলে এয়ারপোর্ট রোডে যানজট থাকবে না। দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষায় থেকে সময় নষ্ট আর যানবাহন থেকে বায়ু দূষণের অবসান হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ফার্মগেট পর্যন্ত হওয়ায় তা ফার্মগেটে যানজট বাড়াবে, এমন মিথ্যা আতঙ্ক জেনেবুঝে ছড়ানো হচ্ছে। সত্য হলো, ফার্মগেট সংলগ্ন বিজ্ঞান কলেজ থেকে এগিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ল্যান্ডিং, যা কোনোভাবেই ফার্মগেট মোড়ে জ্যাম সৃষ্টি করবে না। এই স্থাপনা তৈরিই হয়েছে ঢাকার যানজট কমানোর জন্য।
অদ্ভুত স্ববিরোধিতা
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে নকশাকারদের অন্যতম স্থপতি ইকবাল হাবিব এবং ড. শামসুল হক। ইকবাল হাবিব বাপা”র যুগ্ম সম্পাদক। হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে গেলে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট হবে, পরিবেশ নষ্ট হবে এমন অভিযোগ তোলে বাপা। পরে সে নকশা পরিবর্তন করা হয়। অথচ বাপার একজন শীর্ষ নেতাই এ প্রকল্পের ডিজাইনার। ঢাকার নাগরিক সমাজের নগরপরিকল্পনা নিয়ে সরব ড. শামসুল হক। পান্থকুঞ্জে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্প নামানো সহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। গত ৫ই জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তিনিই প্রধানমন্ত্রীকে ২০২০ সালের নকশা অনুসারেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আর্থিক লাভ
ধারণা করা হয়, ঢাকায় প্রতি বছর যানজটে ১ লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এই ক্ষতির অন্তত ১০ শতাংশ কমাবে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে কোনো অর্থনীতিবিদ এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করেননি। পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে যেভাবে অপেক্ষা করতে হয় এবং অনেক সময় পঁচনশীল দ্রব্য ঝুঁকিতে পড়ে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ায় সেই পরিস্থিতি থাকবে না। পণ্যবাহী ট্রাকগুলো নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। সময় বাঁচবে এবং ভোগান্তি কমবে, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে। সময়, ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তা কমে যাবে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা