মো. আলী আশরাফ খান
বাংলাদেশে লবণ উৎপাদনের ইতিহাস
লবণ উৎপাদন প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ছিল। ‘মুলঙ্গী’ নামে খ্যাত চট্টগ্রামের এক শ্রেণির লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে ‘তোফল’ বলা হতো। মুগল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামক দুটি সরকারি বিভাগ এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছরা এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র ছিল।
ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারিখাতে মাশুল দিতে হতো। মুগল আমল পর্যন্ত লবণ শিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এর ব্যবস্থাপনা ছিল জমিদার শ্রেণীর হাতে, তারা লবণ চাষিদের দিয়ে লবণ উৎপাদন করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাদন প্রদান করত। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ প্রত্যক্ষভাবে ও বেনিয়াদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
লবণ শিল্পে ব্রিটিশদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে বণিক সমিতি গঠিত হয় এবং এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা লাভবান হয়। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস লবণ শিল্পের ওপর সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য প্রয়োগ করে লবণ আবাদের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতাকে লবণ উৎপাদনের জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দিতে শুরু করেন। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ পদ্ধতি রহিত হয়ে বার্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকে। এ পদ্ধতি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
কোম্পানি তখন এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি লবণ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জড়িত হয় এবং যৌথ নিলামের আয়োজন করে বাজারজাতকরণেও সম্পৃক্ত হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির এই আধিপত্য চলতে থাকে। কোম্পানি কর্তৃক আরোপিত কর প্রশাসন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি এবং ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়।
আরও পড়ুন : নুনের সাতকাহন – পর্ব ১৩
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসনের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে ৭৯-৯৯ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। তখন কোম্পানির কর্মচারীরা চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের ব্যবসা করত। পরবর্তীকালে লিভারপুর থেকে লবণ আমদানির কারণে প্রকৃতিজাত এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা বেআইনি ও দন্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে এবং স্বদেশী লবণের উপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করায় এই শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের বহু মুলঙ্গী পেটের দায়ে গোপনে অল্প লবণ প্রস্ত্তত করে জীবন ধারণ করত এবং ধরা পড়ে শাস্তিও ভোগ করত। এভাবে নির্যাতন চালিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছিল।
বিশ শতকের ত্রিশের দশকে মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলনের প্রভাবে লবণ উৎপাদন আবার শুরু হলেও নতুন লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। ১৯৪৭-এর পর থেকে এই লবণ শিল্পটি পুনরুজ্জীবিত হলেও এখানকার উৎপাদিত লবণের উপর অধিক আবগারী শুল্ক ধার্য করায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত খনিজ লবণের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণ পিছনে পড়ে যায়।
# লেখক, মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত), বিসিক।
ফেসবুক :
চলবে …
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা