২০১৯ সালে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ৬৮৩টি ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি নসরুল হামিদ মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান। সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব অ্যাডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মোট ৩৬৫ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সরকার দলীয় নেতা কর্মী সহ অন্যান্য সংগঠনের নেতা কর্মী সমর্থকদের দ্বারা এবং প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে হামলা লুঠপাট সহ নানা ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে প্রকাশিত এবং হিন্দু মহাজোটের জেলা, থানা নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ৬৮৩টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩১,৫০৫ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ৯,৫০৭.২২ একর ভূমি জবর দখল হয়েছে।
২০১৯ সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের রিপোর্ট অনুযায়ী, হত্যা হয়েছে ১০৮টি, হত্যার হুমকি ১১১টি, হত্যার চেষ্টা হয়েছে হত্যা চেষ্টা ৮৮ , জখম, আহত করা হয়েছে ৪৮৪ জনকে, নিখোঁজ ২৬ জন, চাঁদাবাজি ১৫ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা, ক্ষতি ৪৩৩ কোটি ৫৬ লক্ষ ৯৫ হাজার, লুট-পরিবার, মন্দির ২৭৭টি, হামলা বসতবাড়ী, সম্পত্তি ৩৮৭ টি, অগ্নি সংযোগ ৯২ টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৭৯ টি, সম্পত্তি দখল ভূমি ৯ হাজার ৫০৭ একর ২২ শতাংশ। যার মধ্যে গারোদের ৯১৪৭.০৭ একর এবং হিন্দুদের ৩৬০.২২ একর। ঘরবাড়ী ২০ টি, মন্দিরের ভূমি ৩১টি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২৭ টি, দখলের তৎপরতা ৬৬ একর ৫৮ শতাংশ, বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ ৪৩৪ টি পরিবার, উচ্ছেদ তৎপরতার শিকার পরিবার ৬৯০ পরিবার, ৬৬ একর উচ্ছেদের হুমকী ১৬০ পরিবার ।
তিনি জানান, দেশ ত্যাগের হুমকীর শিকার ৬৪১ পরিবার, দেশ ত্যাগে বাধ্যকরণ ৩৭৯ পরিবার, নিরাপত্তাহীনতা ২২৬১ টি পরিবার, মন্দিরে হামলা ভাংচুর অগ্নি সংযোগ ১৫৩ টি, বাড়ীতে হামলা ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ ৪৪৯টি, সঙ্ঘবদ্ধ হামলা ১২৫, প্রতিমা ভাংচুর ২৪৬ টি, প্রতিমা চুরি ৩১ টি, অপহরণ ৭৬ জনকে, অপহরনের চেষ্টা ৭ জনকে, ধর্ষন ৪২ টি, ধর্ষন চেষ্টা ৩৪ টি, গণ ধর্ষণ ১৮ টি, ধর্ষণের পর হত্যা ৬ টি, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও ধর্মান্তর করণের চেষ্টা ১৪৮ জনকে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ৯৯ টি, মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার,বরখাস্ত, আসামী ১০৯ জন, অবরুদ্ধ পরিবার ১০৫ টি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ ৫ টি, মিথ্যা রাজাকার বানানো হিন্দু মুক্তিযোদ্ধা ৩৬ জন, পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় নিষিদ্ধ গোমাংস খাইয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ৫ টি ঘটনা এবং ২২ জনকে ধর্মীয়ভাবে অপবিত্র করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পরিসখ্যান বলে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত হিন্দু নির্যাতন বাড়ছে। গত বছরের তুলনায় সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু নির্যাতন বেড়েছে। গত বছর হত্যা হয়েছিল ৮৮জন এবার বেড়ে হয়েছে ১০৮ জন। গত বছর আহত হয়েছে ৩৪৭ এ বছর বেড়ে হয়েছে ৪৮৪ জন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গত বছর হামলা হয়েছিল ৩৫টি এবছর বেড়ে হয়েছে ৭৯টি। গতবছর বসতবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল ২১৭টি পরিবার এবছর বেড়ে হয়েছে ৪৩৪ টি পরিবার। গত বছর দেশ ত্যাগের হুমকী ছিল ২২৩ টি পরিবার এ বছর বেড়ে গিয়ে ৬৪১টি পরিবার এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ৩৭৮টি পরিবার। গতবছর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল ১৫১০ পরিবার এবছর বেড়ে হয়েছে ২২৬১টি পরিবার। গত বছর মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ১৩১টি এবছর বেড়ে হয়েছে ১৫৩টি। বাড়ীতে হামলা ভাংচুর অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছিলো ১০৮টি এবছর বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৪৪৮টি। গত বছর ভূমি দখল ছিল ২৭৩৪.৮১ একর এ বছর বেড়ে গিয়ে হয়েছে ৯,৫০৭.২২ একর। এবছর নুতন করে ৩৬ জন হিন্দু মুক্তিযোদ্ধার গায়ে রাজকার তকমা যুক্ত হয়েছে। যদিও সরকার দুঃখ প্রকাশ করেছে তথাপি দুষ্টচক্র এই রিপোর্ট নিয়ে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানিত করবে, এখনই সন্দেহের চোখে দেখছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন হয়েছে। সেই নির্যাতনের বিষয় নিয়ে তৎকালীন ক্ষমতাশীন সরকার কোন বিচার করে নাই। বর্তমান আওয়ামী সরকার সেই ন্যাক্কারজনক ঘটনা বিশ্বব্যাপী প্রচার করে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা লাভ করেছে। হিন্দু সমাজ আশা করেছিলো বর্তমান সরকার ২০০১ সালের ঘটনা সহ সকল হিন্দু নির্যাতনের বিচার করবে; অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ১১ বছর দেশ পরিচালনা করলেও ২০০১ সালের ঘটনা সহ কোন অপরাধের বিচার করে নাই, ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য একজনেরও শাস্তি হয় নাই। তাই হিন্দু সম্প্রদায় আজ হতাশ। এই বিচারহীনতার কারনেই অপরাধীরা বার বার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের স্ট্রীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই নিরবে আতঙ্কিত হিন্দু সম্প্রদায় দেশ ত্যাগ করছে। পরিসংখ্যান বলে দেয় এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে এদেশ হিন্দু শুন্য হবে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, হিন্দু মহাজোট একটি অরাজনৈতিক সামাজিক ধর্মীয় সংগঠন। হিন্দু মহাজোট একদিকে যেমন কোন রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করে না; অপরদিকে কোন রাজনৈতিক, সামাজিক ধর্মীয় সংগঠণ বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরনও করে না। হিন্দু মহাজোট সকল মত ও পথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিএনপি, জাতীয়পার্টি ও সুশিল সমাজ হিন্দু মহাজোটের দাবী দাওয়ার প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবী আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় নাই। বরং সরকার দিন দিন মৌলবাদের প্রতি ঝুকছে।
নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রশাসনেও হিন্দু বিদ্বেষ চরম আকারে। প্রতিনিয়ত হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করলেও আজ পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম কটুক্তির অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার করা হয় নাই। উপরন্তু ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শতাধিক হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত শত ঘরবাড়ী পুড়িয়ে, মঠ মন্দির ধ্বংস করে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। সরকার সকল শ্রেনীর পাঠ্যপুস্তক ইসলামীকরণ করেছে। হিন্দু ছাত্র ছাত্রীদেরকে বাধ্যতমূলক ইসলাম ধর্ম পাঠ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। হিন্দু মহাজোট পাঠ্যপুস্তক অসাম্প্রদায়িক করার জোড় দাবী জানাচ্ছে। আমরা আরও দেখেছি নির্বচন কমিশন বিভিন্ন সময় হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের দিনে নির্বাচনের দিন ধার্য করে।
নেতৃবৃন্দ বলেন,গত বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের আপত্তি সত্বেও দুর্গা পুজার দিনে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করেছিলো। এবারও ৩০ জানুয়ারী ২০২০ সরস্বতী পুজার দিন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের জন্য তারিখ নির্ধারণ করেছে। হিন্দু মহাজোট সরস্বতী পুজার দিন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের জন্য জোর দাবী জানাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধ কল্পে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূণঃ প্রতিষ্ঠা করা এবং সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং হিন্দু সম্প্রদায় থেকে একজনকে পূর্ণ মন্ত্রী নিয়োগ করার দাবি জানানো হয়।
একইসঙ্গে, ২০২০ সাল হিন্দু সম্প্রদায় তাদের দাবী আদায়ের বছর হিসেবে ঘোষণা করে গণস্বাক্ষর, মিছিল, মিটিং, অবস্থান কর্মসূচী, সমাবেশ, মহাসমাবেশসহ সকল ধরনের শান্তিপূর্ণ গণকর্মসূচীর প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে যারা উপস্থিত ছিলেন – হিন্দু মহাজোটের সিনিয়র সহ সভাপতি প্রদীপ কুমার পাল, প্রধান সমন্বয়কারী বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য, যুগ্ম মহাসচিব মনিশঙ্কর মন্ডল, আইন সম্পাদক সুব্রত হালদার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অমিও বাউল, মহিলা মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক সাগরিকা মন্ডল, উত্তরবঙ্গ সমন্বয়ক দুলাল কর্মকার, ঢাকা মহানগর দক্ষিনের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ, ঢাকা উত্তরের সভাপতি প্রবীর হালদার, সাধারণ সম্পাদক শুকদেব মন্ডল, সাংগঠনিক সম্পাদক নিপুন পাল, হিন্দু যুব মহাজোট এর সভাপতি কিশোর কুমার বর্মন, সহ সভাপতি সুমন হালদার, মৃনাল কান্তি মধু, ছাত্র মহাজেটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল, দপ্তর সম্পাদক তপু কুন্ডু, ডাঃ মনোরঞ্জন হালদার প্রমূখ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা