আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি)-র অনুমিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, মারা যায় ১ লাখ ৮ হাজার। এই রোগীদের চিকিৎসার জন্য নেই পর্যাপ্ত সুবিধা। যা নিশ্চিত করতে এখনই সরকারের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব ক্যানসার দিবস (৪ ফেব্রুয়ারি) উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় একথা বলেন মার্চ ফর মাদার এর সমন্বয়ক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। ক্যান্সার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও উত্তরণে জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা চাই শীর্ষক সভায় লিখিত বক্তব্য পড়েন তিনি। লালমাটিয়ায় কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টারে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় অংশগ্রহণকারি অতিথিবৃন্দ।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, প্রতিবছর এইদিনটি সুযোগ করে দেয় ক্যানসারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সারা বিশ্বের মানুষকে একত্রিত হতে। এর লক্ষ্য লাখ লাখ প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুরোধ করা। এই রোগ সম্পর্কে ধারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী ব্যক্তি ও সরকারগুলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে এটা সম্ভব।
বিশ্ব ক্যানসার দিবসে চাই গণমাধ্যম ও মানুষের অন্তরে ক্যান্সারের এই চিত্র গেঁথে দিতে।২০১৯-২০২১ এই তিন বছরের জন্য এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমি আছি, আমি থাকবো, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্যানসার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও উত্তরণে করনীয় সম্পর্কে সংক্ষেপে বুলেট আকারে একটি চিত্র তুলে ধরতে চাই। যেকোন দেশে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য দরকার ক্যানসারের আক্রান্তের হার, মৃত্যুরহার, কারা কোন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে সেই সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান। এর জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন।
তিনি জানান, ২০২২ সালের মধ্যে ১৯ টি পুরনো সরকারি মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল ভিত্তিক নিবন্ধন চালু করার উদ্যোগ নেয়ার পরেও তা থেমে গেছে। ২০০৯ সালে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রনীত হয়েছিল ৫ বছর মেয়াদি। ২০১৪ এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু এর অন্তর্ভূক্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে এর আলোকে।প্রয়োজনীয় আপডেট এখনও করা হয় নাই। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকির জন্য গঠিত উচ্চ পর্যায়ের ‘জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল’ প্রায় অকার্যকর। দীর্ঘদিন এই পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই পরিষদের সভাপতি, ক্যানসার ইন্সটিটিউটের পরিচালক পদাধিকার বলে এর সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রী এর প্রধান উপদেষ্টা। এই পরিষদ কার্যকর হলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। আমাদের দেশে ক্যানসারের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো ও অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের পিছনে। ক্যান্সার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত সীমিত।
তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার নির্ণয়ের এক বছরের মধ্যে শতকরা প্রায় পচাত্তর ভাগ রোগী হয় মারা যাচ্ছে, না হলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে।নিম্ন আয়ের এবং অগ্রসর ক্যানসার রোগীরা বেশি ভোগান্তির শিকার হয়। আমাদের দেশের চিত্র এর থেকে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম।
ক্যানসার পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে করনীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উন্নত ব্যবস্থা ও অগ্রসর পর্যায়ের ক্যানসার রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে পারে কমক্ষেত্রে। তাই, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যানসার নির্নয়ের মধ্যে উত্তর খুঁজতে হবে।
চিকিৎসার পাশাপাশি ক্যানসার শনাক্তকরণ ও প্রাথমিক প্রতিরোধে জনসচেতনতার জন্য আনুপাতিক হারে সুনির্দিষ্ট লোকবল ও অর্থ বরাদ্দ। এক- তৃতীয়াংশ ক্যানসার প্রাথমিক প্রতিরোধ করা সম্ভব জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে।এক- তৃতীয়াংশ ক্যানসার রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব, প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয় ও সঠিক পরিপূর্ণ চিকিৎসা দিতে পারলে।
আটটি বিভাগীয় শহরে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরি সরকারের একটি সাহসী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকাসহ আটটি বিভাগে আটটি আঞ্চলিক/ বিভাগীয় ক্যানসার কেন্দ্র (আরসিসি) গড়ে তোলার জন্য আমরা বিগত বছরগুলোতে প্রস্তাব করে আসছিলাম। অত্যন্ত সুখের কথা, সরকার ইতোমধ্যে এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। একনেকে ২৩০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাশ হয়েছে। ১০০ বেডের ইনডোর, বিকিরন চিকিৎসার জন্য একাধিক সর্বাধুনিক টেলিথেরাপি ও একটি ব্রাকি থেরাপি মেশিন, ক্যানসারের অপারেশনের ব্যবস্থা, ইনডোর ও ডে-কেয়ারে কেমো থেরাপির ব্যবস্থা থাকবে। চিকিৎসার অন্যান্য ৫টি বিশেষায়িত বিভাগের সাথে ক্যানসার প্রতিরোধ ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট ক্যানসার ইপিডেমিওলোজির পূর্ণাঙ্গ বিভাগ চালু হবে।
এসময় তিনি জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রন কাউন্সিল পুনর্গঠন ও কার্যকর করা, জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র প্রণয়ন/হালনাগাদ ও এর আলোকে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা, ক্যানসারের সঠিক পরিসংখ্যাণ পেতে জাতীয় ক্যানসার নিবন্ধন কর্মসূচী গ্রহণ করা, এর আওতায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউটে চলমান হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধনকে ডাটাবেজ ও নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে শক্তিশালী করা, প্রতিটি বিভাগে অন্ততঃ একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালভিত্তিক নিবন্ধন সম্প্রসারিত করা, ক্যান্সারের প্রাথমিক প্রতিরোধ তথা জনসচেতনতা ও প্রযোজ্য (হেপাটাইটিস বি ও এইচপিভি) টিকা প্রদান কর্মসূচী চালু করা, মোবাইল ক্যান্সার সচেতনতা ও স্কৃনিং ইউনিট চালু করার সহ ১০টি দাবি তুলে ধরেন।
সভায় বক্তব্য রাখেন কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টারের প্রফেসর সাবেরা খাতুন, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাহেরুল হক, সিসিইপিআর,বির মোসাররত জাহান সৌরভ , অপরাজিতা সোসাইটি এগেইন্সট ক্যান্সারের তাহমিনা গাফফার এবং বাংলাদেশ খ্রিস্টিয়ান উইমেন এসোসিয়েশনের মেরি মার্গারেট রোজারিও।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা