একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বস্তিবাসীরা যে আয়তনের ঘরের জন্য ২৫০০-৩০০০ টাকা মাসিক ভাড়া দেয়, তা ধানমন্ডি-কলাবাগানোর এপার্টমেন্টের ভাড়ার দ্বিগুনের চেয়েও বেশী ভাড়া প্রদান করে। ইউএনডিপির সম্প্রতিক গবেষণার তথ্যমতে ধনী-দরিদ্রের গড় আয়ুর পার্থক্য ১৯ বছর। নিম্ন আয়ের মানুষদের গড় আয়ু যেথানে ৫৯ বছর, সেখানে ধনীদের গড় আয়ু ৭৮ বছর। এই ফলাফলই বলে দেয় তাদের জীবন জীবিকার অবস্থা এবং অবস্থান কোথায়।
বৃহস্পতিবার ( ২৭ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে (ভিআইপি লাউঞ্জ) জলবায়ু পরিবর্তন, নগর দরিদদ্র্রের আবাসন: নগর কর্তৃপক্ষের ভূমিকা” শীর্ষক নাগরিক সংলাপে মূল প্রবন্ধে একথা বলেন মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানাবিধ প্রাকৃতিক আপদ বন্যা, নদীভাঙ্গন, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণীঝড়, জলোচ্ছাস, খরা, শৈতপ্রবাহ, লবনাক্ততা কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ নির্ভর গ্রামীন জনগোষ্ঠি জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে শহরে ভিড় করছে। ফলে সহজ লভ্যতার কারণে তাদের অধিকাংশেরই জায়গা হচ্ছে শহরের অপরিকল্পিত এবং অপরিচ্ছন্ন বস্তিতে ও ফুটপাতের খোলা জায়গায়। তাছাড়াও গ্রাম এবং শহরের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদেরকে শহরে আসতে বাধ্য করছে। ফলে দ্রুত বাড়ছে ঢাকা মহানগরীর আয়তন, জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এবং শহর হারাচ্ছে বাসবাসযোগ্যতা।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়াছে কিন্তু দেশের সকল মানুষ এই সুফল সমানভাবে পাচ্ছেন না। বারসিকের গবেষণায় সর্বোচ্চ ৩৫ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন তারা গ্রাম ছেড়ে শহরের এসেছেন বন্যার ক্ষয়ক্ষতির কারণে। নদী ভাঙ্গনের কারণে ২১ ভাগ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। নগরে যে কোন দূর্যোগ হলে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশী পরে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনের উপর। ঢাকা শহরে বস্তির সমস্যা প্রকট।
প্রবন্ধে বলা হয়, ২০০৫ সালের নগর গবেষণার কেন্দ্রের হিসাব মতে মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ছিল ৩৪,২০,৫২১ জন যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭ দশমিক চার ভাগ। বেসরকারী বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা শহরে ৪০ লক্ষের অধিক বস্তিবাসী বাসবাস করে। এই সংখ্য দিন দিন আরো বেড়েই চলছে। গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার পরিকল্পিত এলাকায় প্রতি একরে বসবাস করে ১২১ জন এবং আর বস্তি এলাকায় প্রতি একরে ৮৫০ জন মানুষ বাস করে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), বারসিক এবং কোয়ালিশন ফর দ্যা পূওর (কাপ)-এর আয়োজনে এ নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংলাপে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে প্রতিদিন গ্রাম ছেড়ে নগরে আসতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। প্রতিবছর প্রায় ৬ লক্ষ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে ঢাকা শহরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে এই সংখ্যা আরো বাড়বে । তাই এ অবস্থা সামাল দিতে এখনই উদ্যোগ নেয়া জরুরী।
বক্তারা বলেন, এই বাস্তহারা মানুষেরা নগরে এসে গৃহহীন হয়ে পড়েন। তাদের সংকট আরো তীব্র হয়। নগরের গৃহহীন দরিদ্র মানুষের আবাসন সংকটের সমাধান হওয়া জরুরি।
নাগরিক সংলাপের প্রধান অতিথি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র জনাব আতিকুল ইসলাম বলেন, নগর দরিদ্রদের আবাসন সংকট বাড়ছে দিনে দিনে। যখন আমি নির্বাচিত হওয়ার পথে, তখন আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গণভবনে যাই এবং রাতে খাবার টেবিলে তিনি আমাকে বলেন, সবার আগে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের আবাসন সংকট সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। বস্তিবাসীরা যাতে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক কিস্তিতে আবাসনের মালিক হতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যারা আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদের সবাইকে নিয়ে নিরাপদ নগর গড়তে চাই। আমার শপথের পর আমি আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সাথে নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই বিষয়ে কাজ করতে চাই।
কাওরান বাজার এলাকার পথবাসী মনোয়ারা বলেন, আমাদের কাজের সুবিধার জন্য এই এলাকাতেই রাত্রি নিবাস তৈরি করার উদ্যোগ নিতে হবে।
অধ্যাপক ড. শহীদুল আমিন বলেন, প্রতিদিন গড়ে সতেরো শো মানুষ ঢাকায় আসে এবং হিসাব করে দেখা গিয়েছে প্রতি বছরে প্রায় ৬ লাখ মানুষ ঢাকা শহরে নতুন করে যুক্ত হয়। তিনি বলেন, নগরের মোট জনসংখ্যার মোট দরিদ্র ৩৫ ভাগ দরিদ্র এবং অতি দরিদ্র ১০ ভাগ যাদের আয় সাত হাজার টাকার নিচে।
বিশেষ অতিথি নগর গবেষণা কেন্দ্র’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, জলবায়ূ পরিবর্তনের কারনে ধারণা করা হচ্ছে ত্রিশ বছরের মধ্যে দেশের উপকূলীয় এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যাবে ফলে দুই থেকে তিন কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্ত হয়ে উচুঁ এলাকায় চলে আসবে। এটা আমাদের দেশের জন্য চিন্তার বিষয়। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে বিবেচনায় রেখে নগর পরিকল্পনা করা দরকার।
বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ এর সঞ্চালনায় নাগরিক সংলাপে সভাপতিত্ব করেন পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। এছাড়া আরো বক্তব্য রাখেন, অধ্যাপক ড. শহীদুল আমিন, বিভাগীয় প্রধান, স্থাপত্য বিভাগ, বুয়েট, প্রফেসর রোকসানা হাফিজ, সাবেক ডিন, স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদ, বুয়েট, ডা. দিবালোক সিংহ, চেয়ারপার্সন, কাপ এবং নির্বাহী পরিচালক, ডিএসকে, কাপ এর নির্বাহী পরিচালক, খোন্দকার রেবেকা সান-ইয়াত, ঢাকা ১৩ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার এনামুল হক আবুল, আওয়ামী বাস্তহারা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লায়ন রাশেদ হালদার, বস্তিবাসীদের নেতা ফাতেমা বেগম, কুলসুম বেগম, হোসনে আরা বেগম রাফেজা, ইডিপির নির্বাহী পরিচালক কাজী বেবি, নাসফের সাধারণ সম্পাদক তৈয়ব আলী প্রমুখ।
সংলাপ থেকে নগরের দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের বস্বিাসীদের জন্য সরকারী উদ্যোগে আবাসন নিশ্চিত করার কাজ দ্রুত শুরু করা, ঢাকাসহ দেশের সকল নগর দরিদদ্রের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী চালু করা, নগর দরিদ্রের জন্য বিনামূল্যে বিশেষ কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, জাতীয় দুর্যোগ পরিকল্পনায় নগরের দুর্যোগ ও ঝুঁকিকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে যুক্ত করা, দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবেলায় নগর দরিদ্রের জন্য বিশেষ ঝুকি ভাতা /প্রনোদনা দেয়া, নগরের সকল বস্তিবাসীদের জন্য সুপেয় পানি, বর্জ্যব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ, জ¦ালানী, স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করা, নগরের বস্তিবাসী শিক্ষার্থীদের স্কুল ঝরেপড়া রোধে নগর কর্তৃপক্ষকে শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করা, সরকারী বেসরকারী জায়গায় গড়ে ওঠা সকল প্রকার বস্তি উচ্ছেদ বন্ধ করা এবং ঢাকা স্ট্রাকচারাল প্লান-২০১৬ বাস্তবায়ন করার দাবি জানানো হয়।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা