অনলাইন ডেস্ক
স্বনামধন্য যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলা শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিনে কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী জন্ম গ্রহন করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ, আধুনিক বাংলা কাব্যের রূপকার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সাগরদাঁড়ি গ্রামের স্থানীয় জমিদার পিতা রাজনারায়ন দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবীর কোল আলোকিত করে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বাঙ্গালীর প্রিয় কবি এই পৃথিবীতে আর্বিভূত হন।
প্রাকৃতিক অপূর্ব লীলাভূমি, পাখি ডাকা, ছায়া ঢাকা, শষ্য সম্ভারে সম্বৃদ্ধ সাগরদাঁড়ি গ্রাম আর বাড়ির পাশে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের সাথে মিলেমিশে তার সুধা পান করে শিশু মধুসূদন ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে পরিনত যুবক হয়ে উঠেন। কপোতাক্ষ নদ আর মধুসূদন” দু’জনার মধ্যে গড়ে উঠে ভালবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন । মধুকবি ১৮২৪ সালে যখন জন্ম গ্রহন করেন সে সময়ে আজকের এই মৃত প্রায় কপোতা নদ কাকের কালো চোখের মত স্বচ্ছ জলে কানায় কানায় পূর্ন আর হরদম জোঁয়ার ভাটায় ছিল পূর্ণযৌবনা। নদের প্রশস্ত বুক চিরে ভেসে যেত পাল তোলা সারি সারি নৌকার বহর আর মাঝির কন্ঠে শোনা যেত হরেক রকম প্রাণ উজাড় করা ভাটিয়ালী ও মুর্শিদি গান। শিশু মধুসূদন এ সব অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত।
স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষের অবিশ্রান্ত ধারায় বয়ে চলা জলকে মায়ের দুধের সাথে তুলনা করে কবি রচনা করেন সেই বিখ্যাত সনেট কবিতা ‘কপোতা নদ’। ‘সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে, সতত তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে’। ছেলেবেলায় নিজ গ্রামের এক পাঠশালায় মাওলানা লুৎফর রহমানের কাছে শিশু মধুসূদন তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহ শিক্ষক হরলাল রায়ের কাছে বাংলা ও ফারসি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু গাঁয়ের পাঠশালায় তিনি বেশি দিন শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। আইনজীবি পিতা রাজনারায়ন দত্ত কর্মের জন্য পরিবার নিয়ে কলকাতার খিদিরপুরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকে ইংরেজী ভাষার প্রতি দূর্বল হয়ে পাড়ি জমান পশ্চিমা দেশ ফ্রান্সে। অবস্থান করেন ভার্সাই নগরীতে। বিদেশী ভাষায় জ্ঞানার্জন করার পাশাপাশি এখানে বসেই তিনি রচনা করেন বাংলায় সনেট বা চর্তুদ্দশপদী কবিতা। সেখানে চলাফেরার এক পর্যায়ে মধুসূদন পর্যায়ক্রমে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ জীবনে ভয়ংঙ্করভাবে অর্থাভাব, ঋণগ্রস্থ ও অসুস্থতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ফিরে আসেন আবারো কলকাতায়। এসময় তার পাশে ২য় স্ত্রী ফরাসি নাগরিক হেনরিয়েটা ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর সকল চাওয়া পাওয়াসহ সকল কিছুর মায়া ত্যাগ করে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার একটি হাসপাতালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
পেছনে ফেলে রেখে যান একগুচ্ছ মনোকষ্ট আর অভিমান। মহাকবির মৃত্যুর পর ১৮৯০ সালে কবির ভাইয়ের মেয়ে মানকুমারি বসু সাগরদাঁড়িতে প্রথম স্মরনসভার আয়োজন করেন। সেই থেকে শুরু হয় মধুজন্মজয়ন্তী ও মধুমেলার। ১৯৯৭ সালে কবির জন্মজয়ন্তী ও মধুমেলা উদ্বোধন কালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষে সাগরদাঁড়িতে পর্যটন কেন্দ্র ও মধুপল্লী গড়ে তোলার ঘোষণা দেন । সেই থেকে প্রতিবছর সরকারীভাবে ২৫ জানুয়ারি পালন করা হয় সপ্তাহ ব্যাপি মধুমেলা। তারপর রাজ বাড়িটি পূণসংষ্কার করা হয়। জমিদার বাড়ির সামনে রয়েছে কবি মধুসূদন দত্তের দু’টি আবক্ষ মূর্তি। কবির বাসগৃহটি ১৯৭০ সালে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করেন। এই বাড়ির ভেতর খোলা হয়েছে যাদুঘর সেখানে মধুসূদনের পরিবারের ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক, আলনা গচ্ছিত করে রাখা হয়েছে। বাড়িটির চারপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির পশ্চিম পাশে বিশাল আকৃতির পুকুর। পুকুরের যে ঘাটে বসে কবি মধুসূদন স্ন্যান করতেন সেই পাকাঘাটটি আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। পুকুরের দক্ষিণ পাশে রয়েছে কবির স্মৃতি বিজড়িত কাট বাদাম গাছ। কবি ছোট বেলায় এই গাছের গোড়ায় বসে কবিতা লিখতেন। আজ পরিচর্যার অভাবে গাছটি মৃত প্রায়। গাছের গোড়ার ইটের গাঁথুনি খুলে বণ বিভাগ অথবা কৃষি অধিদপ্তরের আওতায় এনে গাছের পরিচর্যা করা হলে মধুস্মৃতি জড়িত গাছটাকে আরো কয়েক বছর বাঁচিয়ে রাখা যেত।
১৮৩০ সালে মধুসূদন সাগরদাঁড়ি ছেড়ে কোলকাতা খিদিরপুর যান বাবার সাথে। তারপথ দীর্ঘপথ চলা। কিন্তু ভোলেননি তার জন্মস্থানের কথা, কপোতাক্ষ নদের কথা। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে ১৮৬২ সালে কবি স্ত্রী-পুত্র কন্যাকে নিয়ে নদী পথে বেড়াতে আসেন সাগরদাঁড়িতে। কিন্তু মায়ের দেখা পাননি। দাম্ভিক পিতার ধর্ম ও কুসংস্কার নাস্তিক পুত্রকে মায়ের সাথে দেখা করতে দেয়নি। তখন তিনি চলে যান মামার বাড়ি পাইকগাছার কাঠি পাড়া গ্রামে। মামা বংশধর ঘোষের বাড়ি তিনি সমাদর পান। সেখান থেকে তিনি মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে তাবুতে কয়েকদিন অপক্ষা করে আবার কলকাতায় চলে যান। এর পর তিনি আর দেশে ফেরেননি। কবির এই স্মৃতি বিজড়িত বিদায় ঘাট সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। সাগরদাঁড়ি থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার উত্তরদিকে শেখপুরা গ্রামে অবস্থিত ত্রিগম্বুজ জামে মসজিদ। মসজিদটি আঠারো দশকে মোঘল আমলে নির্মিত। এই মসজিদের তৎকালিন ঈমাম ফার্সি পন্ডিত খন্দকার মখমল আহম্মেদের কাছে মধুসূদন শৈশবে বাংলা ও ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন। কবির স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদটি সংস্কারের অভাবে জরাজির্ন হয়ে পড়লে পরবর্তিতে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় সংস্কার করা হয়। মসজিদটি দেখলেই কবির শৈশব স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কবিকে স্মরণ করতে সাগরদাঁড়িতে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে প্রায় দু’কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতি বছর ২৫ জানুয়ারি থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ৭ দিন ব্যাপি মধূ মেলা হয়ে থাকে কিন্তু এবার করোনা ভাইরাস এর কারণে বসবেনা কোন মেলা।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহি অফিসার এম.এম আরাফাত হোসেন জানান, কোভিড ১৯ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এবছর শুধুমাত্র কোবির প্রকৃতিতে পুষ্প অর্পণ করা হবে সেখানে যশোর জেলা প্রশাসক অথবা তার প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেনএ পুষ্প অর্পণ এরপর ভার্চুয়াল আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠান শেষ করা হবে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা