দলের মধ্যকার সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়েছেন। যেকোনো মূল্যে তিনি বিতর্কিত নেতাকর্মীদের লাগাম টেনে ধরতে চান। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কয়েকজন গডফাদার চলমান এ অভিযান নিয়ে ক্ষুব্ধ। তাঁরা এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তৎপর রয়েছেন। গডফাদাররা গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁদের সাক্ষাতের অনুমতি দেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগে ওই গডফাদাররা তাঁর সঙ্গে আবারও সাক্ষাৎ করে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা ত্যাগের আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের অভিযান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। গণভবনসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাতে সাক্ষাৎ করেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো নালিশ শুনতে চাই না। ছাত্রলীগের পর যুবলীগকে ধরেছি। নিজেদের ইমেজ বাড়াতে হবে। নীতি ও আদর্শ নিয়ে চলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সমাজের অসংগতি দূর করতে হবে। একে একে এসব ধরতে হবে, আমি করব। জানি কঠিন কাজ; কিন্তু করব। জানি বাধা আসবে; কিন্তু আমি করবই।’ তিনি ছাত্রলীগ নেতাদের শো-অফের রাজনীতি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘কোনো শো-অফ চলবে না। সংগঠনকে ব্যবহার করে কেউ অপরাধ করলে তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ এ সময় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অনড় অবস্থানের পর গতকাল শুক্রবার যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা জি কে শামীমের বাড়িতে অভিযান চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তারের পরপরই এই সংগঠনের গডফাদাররা তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করার জন্য। এই গডফাদাররা সবাই যুবলীগের সাবেক শীর্ষ নেতা। তাঁরা বরাবরই সরকারের ক্ষমতার খুব কাছাকাছি অবস্থান করে আসছেন। এর মধ্যে দুজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আরেকজন সম্পাদকমণ্ডলীতে রয়েছেন। অবশ্য ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে যুক্ত যুবলীগের আরেকজন শীর্ষ নেতাও গডফাদারদের দলে রয়েছেন। এই নেতা যুবলীগের বিতর্কিত, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের রক্ষায় তৎপর রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার গণভবনে উপস্থিত ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এমন একজন শীর্ষ নেতা বলেন, যুবলীগের বিতর্কিত নেতাদের নাম আলোচনায় আসার পর সংগঠনটির মহানগর দক্ষিণ শাখা ভেঙে দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে আলোচনা হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ চার নেতার গণভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন—মইনুল হোসেন খান নিখিল, সভাপতি, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ, মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সভাপতি, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ, রেজাউল করিম রেজা, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ। গত বৃহস্পতিবার রাতেও এ নিয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘চলমান শুদ্ধি অভিযানে দেশের মানুষ খুশি। এতে সরকারের ইমেজ বাড়ছে। এই শুদ্ধি অভিযান এখনই বন্ধ করে দিলে জনগণের কাছে ভিন্ন বার্তা যাবে, যা আওয়ামী লীগ ও সরকারের জন্য ইতিবাচক হবে না।’ ওই নেতা জানান, সেখানে (গণভবনে) ক্যাসিনোতে অভিযানের দিন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী যে মন্তব্য করেন, সে বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ওই দিন র্যাবের অভিযানের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, ‘এত দিন অবৈধভাবে ক্যাসিনো চলল কিভাবে? পুলিশ বা র্যাব এত দিন কী করেছে?’ এসব প্রশ্নের পাশাপাশি র্যাবের অভিযানকে রাজনীতিবিরোধী ষড়যন্ত্র বলেও অভিযোগ করেন তিনি। পরে অবশ্য তিনি কিছুটা সুর নরম করে বলেন, অবৈধ ক্যাসিনো বা জুয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুবলীগের নেতারা জড়িত বলে যেসব অভিযোগ এসেছে, তা তাঁর জানা ছিল না। এখন সংবাদমাধ্যমে খবর আসার পর তিনি জানতে পেরেছেন।
যুবলীগের একটি সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীতে যুবলীগের কয়েকজন নেতা বেশির ভাগ টেন্ডারবাজি, চাঁদার টাকা নিয়ন্ত্রণ, দখলসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন। বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকার শেষ দিকে এবং এরপর ডিসিসিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হলে ওই প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কাজের নিয়ন্ত্রণ করতেন যুবলীগের তিনজন শীর্ষ নেতা। এর মধ্যে দুজন বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে রয়েছেন। তৎকালীন যুবলীগের দুই শীর্ষ নেতার হয়ে ঢাকা মহানগর যুবলীগের তৎকালীন একজন নেতা ডিসিসির কাজের নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। পরে তাঁর হাত বদল হয়ে নেতৃত্ব চলে যায় যুবলীগের আরেকজন নেতার কাছে। তবে সব সময় এসব নেতাকে মদদ দিয়ে এসেছেন ক্ষমতাবলয়ের খুব কাছাকাছি থাকা যুবলীগের আরো একজন সাবেক শীর্ষ নেতা। তিনি এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অবস্থান করছেন।
কিন্তু যুবলীগের সাবেক এই নেতা এতটাই প্রভাবশালী যে তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠনের কেউ টুঁ শব্দ করতে পারেন না। যুবলীগের নেতৃত্বে আসার জন্য এখনো তাঁর আশীর্বাদের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা ওয়ান-ইলেভেনের সময় সবার আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সমালোচনা করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের রাজনীতিতে শীর্ষ পদে অবস্থান করলেও বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তাঁর ঠাঁই হয়নি মন্ত্রিসভায়।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর তাঁরা প্রথম এই ধরনের অপরাধের বিষয়টি জানতে পারেন। এ নিয়ে দলের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ কাজে যুবলীগ নেতাদের সম্পৃক্ততায় তাঁরা বিস্মিত। তবে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনড় অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে চলমান শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখার পক্ষেই তাঁরা মত দিয়েছেন। কালের কণ্ঠ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা