নব্বই দশকের শেষ দিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে জেমস মানেই উন্মাদনা। তখন ব্যান্ডসংগীতের স্বর্ণযুগ। তখনকার তরুণ প্রজন্মের রেওয়াজ ছিল হাই ভলিউমে ব্যান্ডের গান বাজানো। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। আম্মুকে ম্যানেজ করতে পারলেও বিপত্তি ছিল আব্বুকে নিয়ে। তিনি হাই ভলিউমে গান বাজানো পছন্দ না করলেও সমস্যা ছিল না। তাঁর মূল রাগ ব্যান্ডসংগীতের ওপর। তিনি যেমন ব্যান্ডসংগীত অপছন্দ করতেন, তেমনি ব্যান্ডশিল্পীরা ছিল তাঁর চক্ষুশূল। তখন বিটিভিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ব্যান্ড শো। বাসায় টিভি থাকলেও প্রগ্রামটা দেখতে হতো প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে। আব্বুর ধারণা, ‘ব্যান্ডসংগীতের শ্রোতারা আধা পাগল আর শিল্পীরা পুরা পাগল। কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ ব্যান্ডসংগীত শুনবে না। এরা গানের নামে বেসুরো গলায় চিৎকার-চেঁচামেচি করে।’
আমি ছিলাম ব্যান্ডসংগীতের অন্ধ ভক্ত। নতুন কোনো অডিও ক্যাসেট রিলিজ হওয়া মাত্রই সেটা কিনে নিতাম। হাই ভলিউমে গান বাজিয়ে মহল্লার সবাইকে জানান দিতাম। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠত। তবে সব কিছুই হতো, আব্বু যখন অফিসে থাকতেন কিংবা বাসার বাইরে। ওই সময় ‘শুধু তোমারই কারণে’ শিরোনামে একটি মিক্সড অডিও অ্যালবাম রিলিজ হয়। অ্যালবামে জেমসের একটি সুপার হিট গান ছিল ‘প্রথম স্পর্শ’। গানের কথাগুলো ছিল এমন—‘প্রথম স্পর্শ, প্রথম অনুভূতি, প্রথম প্রেম, প্রথম আকুতি, প্রথম কামনা, প্রথম বাসনা, প্রথম মিলনে, চরম যাতনা…।’ এই গানের কথা ও জেমসের গাওয়ায় ছিল দারুণ উত্তেজনা ও উন্মাদনা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে হাই ভলিউম দিয়ে গানটি বাজিয়ে নিজেও জেমসের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলাম।
হঠাৎ দেখি আব্বু আমার সামনে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি অডিও প্লেয়ার আছড়ে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দিলেন। আমি এক দৌড়ে বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরেও শেষ রক্ষা হলো না। আব্বু আমাকে রাতে ডিনারের সঙ্গে ডেজার্ট হিসেবে কিছু উত্তম-মধ্যম দিলেন। এটাই ছিল আব্বুর হাতে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ সিরিয়াস মার খাওয়া। আমার অপরাধ ছিল, আমি অত্যন্ত অশ্লীল একটা গান বাজাচ্ছি এবং নিজেও চিৎকার করে গাইছি। এসব অশ্লীল গান শুনে দিনে দিনে আমি নষ্ট হয়ে যাব। এই গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে ভবিষ্যতে আমাকে আর কখনো অডিও প্লেয়ার কিনে দেওয়া হবে না। সেদিন রাতে যতটা না শরীরের ব্যথায় কেঁদেছিলাম, তারচেয়েও বেশি কেঁদেছিলাম অডিও প্লেয়ারের মায়ায়। মহল্লায় আমার আর মান-সম্মান বলে কিছুই থাকবে না—এই কষ্টে অনেক রাত নীরবে চোখের জল ফেলেছি।
কিছুদিন পর আম্মু কিভাবে যেন আব্বুকে ম্যানেজ করে ফেললেন। আব্বুর হাত দিয়েই দুই মাস ব্যবধানে বাসায় আবারও নতুন একটা অডিও প্লেয়ারের আগমন ঘটে। তবে এবার শর্ত দেওয়া হলো, কোনো ব্যান্ডের গান বাজানো যাবে না। অবশ্যই কম ভলিউমে গান বাজাতে হবে। মরুভূমিতে গরু চরানো আর ব্যান্ডসংগীত ছাড়া অডিও প্লেয়ার বাজানো আমার কাছে একই রকম ছিল। আব্বুর যখন ১১ বছর বয়স, তখন দাদা মারা যান। অনেক চিন্তাভাবনা করে একটা বুদ্ধি বের করলাম। একদিন আব্বু বাসায় বিছানায় শুয়ে পত্রিকা পড়ছেন, তখন আমি ইচ্ছা করেই জেমসের বিখ্যাত ‘বাবা’ গানটি বাজাতে লাগলাম। এই গানটি পর পর তিনবার বাজানোর পর আব্বু আমাকে ডাকলেন। কাছে গিয়ে দেখি আব্বুর চোখের কোণে পানি জমে আছে। আমাকে বললেন, ‘এখন যে বাজাচ্ছিস, এই গানের কথা ও সুর খুব সুন্দর। শিল্পীর নাম কী?’ আমি তখন উত্তর দিলাম, ‘যে ব্যান্ডশিল্পীর গান শুনে দুই মাস আগে অডিও প্লেয়ার ভেঙে ছিলেন, এটা সেই শিল্পীর গান।’
তখন আব্বু এমনভাবে হাঁ করে আমার দিকে তাকালেন, যেন আকাশ থেকে মাটিতে পড়েছেন। বললেন, ‘এটা কি ওই অশ্লীল শিল্পীর গান, তুই কি সত্যি কথা বলছিস?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এটা ওই শিল্পীর গান। তবে তিনি অশ্লীল শিল্পী নন এবং ওই গানটাও অশ্লীল ছিল না। উনার নাম হচ্ছে মাহফুজ আনাম জেমস, খুব জনপ্রিয় শিল্পী।’ আব্বু তখন বললেন, ‘ব্যান্ডের কিছু কিছু গান ভালো, তবে ওই গানের প্রতিটি কথাই কিন্তু অশ্লীল ছিল।’ সেদিনের পর থেকে বাসায় ব্যান্ড গান বাজানোর অলিখিত লাইসেন্স পেয়ে যাই। যখনই জেমসের ‘বাবা’ গানটা কানের কাছে শুনতে পাই, তখনই আমার বাবাকে নিয়ে এই মধুর স্মৃতিগুলো খুব বেশি মনে পড়ে।
NB:This post is copied from kalerkantho
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা