ফজলুল বারী : অস্ট্রেলিয়ায় আমি নতুন আসা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের প্রথম সংগ্রামের দিনগুলোয় সহযোগী বন্ধু হতে চেষ্টা করি। বাংলাদেশের ক্রিম ছেলেমেয়েগুলোই আইএলটিএস স্কোর সহ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে পড়তে আসে। ব্যয়বহুল দেশে পা দিয়েই তাদের সিংহভাগ খুঁজে একটি চাকরি। এদেশে বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের প্রথম চাকরি মানে কিচেনহ্যান্ড-ক্লিনিং অথবা দোকান কর্মচারীর কাজ। এক দু’দিন দেখিয়ে দিলেই যে কেউ এসব কাজ করতে পারে। কাজটার সঙ্গে আমি শুধু সংযোগ ঘটিয়ে দিতে পারি। কিন্তু কাজটা করতে হয় তাকে। কাজটি ধরে রাখতে হয় তাকে। আমার মূল কাজটি হলো কাউন্সিলিং তথা কাজ পাবার বিষয়ে নতুন একজনকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা। নতুনদের আইনানুগ দেশে আইনানুগ রাখাই প্রথম দিকের বড় একটি সংগ্রাম। ছেলেমেয়েগুলো আমাদের অনেক স্মার্ট। আমি তাদের একজন ভাই-বন্ধু অথবা অভিভাবকের ভূমিকায় তাদের জয় করতে পারি। চেষ্টা আর সময় দেয়াটাই মূল। সবাইকে একটা কথা বারবার বুঝাই। তাহলো নিজেকে উপস্থাপন, যথাযথভাবে সেল করতে হবে। আগে দর্শনধারী, পরে গুনবিচারী। কাজ হবেই। স্মার্ট ছেলেমেয়েগুলোকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলায় যখন কাজ হয়ে যায়, আনন্দ প্রতিক্রিয়ায় তাদের প্রথম স্বগোতোক্তি হয়, আপনি যেভাবে বলেছিলেন, বারী ভাই!
দেশে থাকতে আমাকে বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্স-ট্যুরিজম বোর্ড প্রায় দাওয়াত করে তাদের দেশে নিয়ে যেতো। দেখাতো তাদের দেশের সবচেয়ে সুন্দর সব স্পট-ঐতিহ্য। তাদের ধারনা ছিল এসব আমি লিখলে আরও বেশি সংখ্যক পর্যটক তাদের দেশে যাবে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাতে বাংলাদেশের লোকজন এমনিতে নানা প্রয়োজনে যায়। আমার রিপোর্টগুলো তখন মরিশাস-উজবেকিস্তানের মতো দেশেও অনেক পর্যটক নিয়ে গিয়েছিল। এসব দেশের নানাকিছু দেখেশুনে মনে হতো আমাদের দেখানোর মতো ঢের বেশি আছে। কিন্তু আমরা আমাদের দেশটাকে যথাযথ মেলে ধরতে পারছিনা। ছোট্ট একটি খালের মতো সিঙ্গাপুর রিভারকে তারা কতো যত্ম করে পর্যটকদের দেখায়। কিন্তু আমাদের দেখানোর মতো কত সুন্দর সব নদী! চীনা নববর্ষ উপলক্ষে চাঙ্গি প্যারেড দেখাতে তারা সারা দুনিয়া থেকে সাংবাদিক-ট্যুর অপারেটরদের নিয়ে যায়। যা আমাদের পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার কাছে নস্যি।
একুশে ফেব্রুয়ারি যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো তখন বলা হয়েছিল এখন থেকে সারা বিশ্বেই একুশ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন হবে। এটি বিশ্বের দেশে দেশে প্রচার-জনমত গঠনের জন্যে বাংলাদেশের কাছে তখন একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে প্রামান্য দলিলাদি চেয়েছিল ইউনেস্কো। কিন্তু বাংলাদেশ এই কাজটি আন্তরিকভাবে করতে পারেনি। দেশে থাকতে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারির আগে একটা রুটিন রিপোর্ট করতাম। তাহলো বাংলাদেশ এবারেও ইউনেস্কোর চাহিদামতো একুশের ইতিহাসের প্রামান্য দলিলাদি সরবরাহ করতে পারেনি। এই রিপোর্টটি এখন আর হয়না। সারা দুনিয়ার দেশে দেশে এই দিনটি পালন করেন মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যেভাবে দেশ দেশে সে সব দেশের সরকারি উদ্যোগে পালন হবার কথা ছিল সেটি হয়না। এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের। অথচ এখন প্রবাসী বাংলাদেশি ছাড়াও গার্মেন্টস পণ্য, ক্রিকেটের কারনেও বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি মানুষ বাংলাদেশকে চেনেন জানেন। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোল ডিসেম্বর এই দিনগুলো বাংলাদেশে পালিত হয়, এই দিনগুলোর উদযাপন দেখাতে আমরা অনেক বেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারতাম।
এক সময় স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের অতিথি করে নিয়ে আসা হতো। নেলসন ম্যান্ডেলা, ইয়াসির আরাফাতের মতো নেতাও স্বাধীনতা দিবসের অতিথি হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারনে সেই প্রথাও এখন বিলুপ্ত! অথচ আমাদের জাতীয় কর্মসূচিতে বিশ্ব নেতাদের উপস্থিতি আমাদের উদযাপনগুলোকে বিশেষ ব্যঞ্জনা দিতো। সম্ভবত দেশীয় রাজনৈতিক সমস্যার কারনে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের দাওয়াত বন্ধ হয়েছে। তাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গিয়েও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গিয়ে নালিশ করে। বাংলাদেশের সরকারি টাকাপয়সা হজম করার জন্যে পর্যটক কর্পোরেশন নামের একটি সংস্থা আছে। জাতীয় দিবসগুলোয় বিদেশি পর্যটকদের দেশে নিয়ে আসার কথা এই সংস্থাটি কী কোন দিন ভেবেছে?
এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আগে একটি ব্যক্তিগত উপলদ্ধি থেকে এ লেখার কথা ভাবনায় আসে। আমার বন্ধু কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশ রওয়ানার আগে ক্ষুদে বার্তায় জানালেন, ‘কাল ঢাকা চললাম দাদা। একুশের শহীদ মিনারে ফুল দেব’। অনমিত্র আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা তাঁর রিপোর্টে একজন চুরাশি বছরের সন্ধ্যারানির কথা লিখেছেন। যাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে একুশের শহীদ মিনারে নিয়ে আসেন তার ছেলে বরুন নাগ। মায়ের দীর্ঘদিনের ইচ্ছাপূরনে পশ্চিমবঙ্গের নিউ ব্যারাকপুর থেকে একুশ উপলক্ষেই বাংলাদেশে এসেছেন এই মা ও ছেলে। আসামের ভাষা সংগ্রামী নিশীথবাবুর বর্ননাও আছে এই রিপোর্টে। ৮৯ বছরের নিশীথবাবুও একুশ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশে এসেছেন।
এই দুটি উদাহরন পড়ে মনে হলো বাংলাদেশ কী কখনও ভেবেছে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষেও পর্যটকদের আনা যায় বাংলাদেশে? পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা সিঙ্গাপুরে চেঙ্গি প্যারেডের চেয়ে অনেক আকর্ষনীয়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে বাংলাদেশ যে বর্ণিল রূপ নেয়, তা বিদেশি পর্যটকদের মুগ্ধ করবেই। এসব দেখতেইতো পর্যটকরা দেশে দেশে যান। ভারতের সঙ্গে যেহেতু ট্রেন-বাসও চালু আছে আপাতত ভারত থেকেওতো অনেক পর্যটক নিয়ে আসা যায়। এমন দিন দেখে এক দু’বছর যদি ঘোষনা দিয়ে যদি ট্রেন-বাস ভর্তি করে ফ্রি পর্যটকও যদি আনা হয়, আখেরে বাংলাদেশের ক্ষতি হবেনা। কিন্তু বাংলাদেশের সে উদ্যোগ কোথায়? সরকারি টাকা হজম করাই যাদের মূল ব্রত সেই পর্যটন কর্পোরেশন দিয়ে এসব হবে টবেনা। বেসরকারি ট্যুর অপারেটররা সুন্দরবন দেখাতে বিদেশ থেকে পর্যটক নিয়ে আসেন। এরসঙ্গে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের মতো দিনগুলোকে কী এসব ট্যুর প্যাকেজের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো যায়? পর্যটন-সংস্কৃতি-মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় জাতীয় দিবসগুলো উপলক্ষে যদি বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক-শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বেশি বেশি নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয় তাদের লেখার মাধ্যমেও আরও বেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে আনা সম্ভব। লেটস স্টার্ট প্রিয় বাংলাদেশ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা