ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএন উইমেন বুধবার (৪ মার্চ) নতুন এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি সংখ্যক মেয়ে শিশু স্কুলে যাচ্ছে এবং স্কুলে পড়াশোনা অব্যাহত রাখছে। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন থাকলেও তা মেয়েদের জন্য আরও সমতাভিত্তিক ও কম সহিংস পরিবেশ তৈরিতে সহায়তার ক্ষেত্রে সামান্যই ভূমিকা রেখেছে।
নারীর অবস্থা বিষয়ক কমিশনের ৬৪তম অধিবেশনের আগে প্রকাশিত ‘মেয়েদের জন্য একটি নতুন যুগ: ২৫ বছরের অগ্রগতির খতিয়ান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী স্কুলের বাইরে থাকা মেয়েদের সংখ্যা কমে ৭ কোটি ৯০ লাখে নেমে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরাই বেশি আগ্রহী ছিল শুধু গত দশকেই।
তা সত্ত্বেও নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখনও নিয়মিত ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী পাচারের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের শনাক্ত করা গেছে তাদের ৭০ শতাংশই ছিল নারী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন শোষণের কারণে তারা পাচারের শিকার হয়। বিশ্বব্যাপী ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রতি ২০ জন মেয়ের মধ্যে একজন বা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মেয়ে তাদের জীবনে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা নারী ও মেয়ে শিশুরা যত ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার মধ্যে সবচেয়ে সহিংস রূপগুলোর একটি।
শিক্ষা, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এই নেতিবাচক প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ১৪-২৪ বছর বয়সী প্রায় ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মহিলা এখন সাক্ষর। তারপরও মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস) ২০১৯ অনুসারে, বিগত এক মাসে লালন পালন কারীদের দ্বারা যেকোনো ধরনের শারীরিক বা মানসিক শাস্তি বা আগ্রাসনের মুখোমুখি হওয়া ১-১৪ বছর বয়সী শিশুর হার ছিল ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
এমআইসিএস ২০১৯-এ আরও উঠে এসেছে যে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৩৭ শতাংশ সন্ধ্যার পর একা চলাফেরার ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করে না। ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের অর্ধেকের বেশির বিয়ে হয় তাদের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই। প্রায় ২৪ শতাংশ নারী অপরিণত বয়সে সন্তানের জন্ম দিচ্ছে।
এদিকে, বাংলাদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর একজন (২৫.৪ শতাংশ) নিম্নোক্ত পরিস্থিতিগুলোর যেকোনো একটি তৈরি হলে স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে প্রহার করা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন: স্বামীকে কিছু না জানিয়ে ঘরের বাইরে গেলে, সন্তানদের প্রতি অবহেলা করলে, স্বামীরসাথে তর্ক করলে, স্বামীরসাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানালে এবং খাবার পুড়িয়ে ফেললে।
জরীপের এসব নতুন ফলাফল সত্ত্বেও সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গিকারকে ইউনিসেফ স্বাগত জানায়। চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ নম্বর, যেখানে শিশুরা সরাসরি সহিংসতার ঘটনা জানাতে ও এর থেকে প্রতিকারের জন্য সাহায্য চাইতে পারে, সরকার ও ইউনিসেফের যৌথ প্রচেষ্টার একটা সফল উদাহরন।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, পঁচিশ বছর আগে বিশ্বের সরকারগুলো নারী ও মেয়ে শিশুদের প্রতি যে প্রতিশ্রুতি করেছিল, তারাকেবল তার আংশিক সুবিচার করতে পেরেছে। যদিও বিশ্ব অনেক বেশি সংখ্যক মেয়ে শিশুকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে অনেক রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছে, তবে নিজেদের ভাগ্য গঠনের পাশাপাশি নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার জন্য তাদের যে দক্ষতা ও সহায়তা প্রয়োজন তা প্রদানে বিশ্ব বিব্রতকরভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
এই বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে জেনারেশন ইক্যুয়ালিটি প্রচারাভিযানের প্রেক্ষাপটে এবং নারী ও মেয়েশিশুদের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক নীলনকশা হিসেবে পরিচিত বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের ২৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যান-ব্রিজিত অ্যালব্রেস্টেন বলেন, ঐতিহাসিক বেইজিং ঘোষণার প্রতি সরকারগুলোর করা প্রতিশ্রুতির বিষয়ে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং ২৫ বছর পর মেয়েদের জন্য বিশ্ব কতটা অনুকূলে এসেছে তার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছে এই প্রতিবেদন।
ইউএন উইমেনের নির্বাহী পরিচালক ফুমজাইল ম্লাবমো-এনজিকুকা বলেন, বেইজিংয়ে ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘মেয়ে শিশু’ ইস্যুতে নির্দিষ্টভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং এরপর থেকে আমরা ক্রমবর্ধমানভাবে মেয়েদেরকে তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে এবং এক্ষেত্রে জবাবদিহিতানিশ্চিতকরতে তাদের আহ্বান শুনেছি। তবে পৃথিবীর দায়িত্বশীল রক্ষক হিসেবে, নারীদের জন্যসহিংসতামুক্ত জীবন এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে বিশ্ব তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে পারেনি।
মেয়েরা আজ প্রতিটি জায়গাতেই সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে– অনলাইন থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষ, বাড়ি ও কমিউনিটি সবখানেই– যা তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক উন্নতির জন্য নেতিবাচক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুবিয়ের মতো ক্ষতিকর সামাজিক প্রথার কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মেয়ের জীবন ও সম্ভাবনা নষ্ট হওয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রতিবছর, ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ের শৈশবেই বিয়ে হয়ে যায়। বৈশ্বিকভাবে, ১৫-১৯ বছর বয়সী মেয়েরা একই বয়সের ছেলেদের মতো স্ত্রী-প্রহারকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে।
প্রতিবেদনে মেয়েদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নেতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে, যার অনেকগুলো ২৫ বছর আগে চিন্তাও করা যায়নি। ঐতিহ্যবাহী খাবার থেকে প্রক্রিয়াজাত ও অস্বাস্থ্যকর খাবারের দিকে ধাবিত হওয়ায় অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং চিনি-যুক্ত কোমল পানীয় গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে, যার কারণে মেয়েদের স্থূলতার সমস্যাও বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে অতিরিক্ত ওজনের মেয়ের সংখ্যা ১৫ কোটি ৫০ লাখ, যা ১৯৯৫ সালের (৭ কোটি ৫০ লাখ) তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
গত ২৫ বছরে দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উদ্বেগ বাড়তে দেখা গেছে, যার পেছনে অত্যধিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারেরও প্রভাব রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মেয়েদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। এক্ষেত্রে এগিয়ে কেবল মাতৃত্বজনিত কারণে মৃত্যু।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা