অনলাইন ডেস্ক
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর আবাসিক প্লট অ-আবাসিক বা বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরকরণ একাধিক নথি থেকে জানা গেছে, এসব ফাইলে সরাসরি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করছে। বিধি মোতাবেক নথিগুলো রাজউক থেকে মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার কথা কিন্ত বেশ কিছু নথিতে দেখা গেছে যে, প্লট মালিক সরাসরি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর বরাবরে আবেদন করেছেন। আর প্রতিমন্ত্রী দ্রুততার সাথে সেগুলো সচিবকে মার্ক করে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
এ ধরনের একটি নথিতে ডিপ্লোম্যাটিক জোনের নিরাপত্তা ও ট্রাফিক সমস্যার কথা বিবেচনা করে সচিব আপত্তি নোট দিলেও প্রতিমন্ত্রী সেটি উপেক্ষা করে নথিটি সরাসরি নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন। এ ঘটনায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউক কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়েছেন। তারা প্রশ্ন তুলেছেন প্রতিমন্ত্রী কি এটা করতে পারেন?
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রাজউকের আওতায় গুলশান আবাসিক এলাকার এনডব্লিউ (এইচ) ব্লকের ১৫ কাঠার ১৭৯ নং প্লটটি অস্বাভাবিক গতিতে অ-আবাসিক ও বাণিজ্যিক প্লটে রুপান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই প্লটটি রাজউকের একটি আবাসিক প্লট। সেটির মালিকানা পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড মালিক কর্তৃক নিযুক্ত আম-মোক্তার। তারা এই আবাসিক প্লটটিতে ২০ তলা অ-আবাসিক বাণিজ্যিক ভবন করার জন্য গত ২৫/১০/২০২১ ইং তারিখে সরাসরি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রীর বরাবরে আবেদন করেন। যার প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর ডাইরী নং ১১৮৭ তারিখ: ২৫/১০/২০২১ইং। প্রতিমন্ত্রী সেই দিনই আবেদনটির ওপর নোট দেন। নোটে তিনি সচিবকে নথি পেশ করার আদেশ দেন।
আবেদনপত্রে নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম বলেন, ‘সবিনয় নিবেদন করছি যে, আমি নিন্ম স্বাক্ষরকারী গুলশানস্থিত আবাসিক এলাকার প্লট নং ১৭৯, ব্লক-এনডব্লিউ (এইচ) গুলশান উত্তর এভিনিউ, গুলশান ঢাকা-এর নিযুক্তীয় আম-মোক্তার। উক্ত ১৫ কাঠা আয়তনের প্লটটি ১০০ ফুট প্রশস্থ গুলশান নর্থ এভিনিউ এবং ৩০ ফুট প্রশস্থ ৬৯ ও ৭০ নম্বর রোডের পার্শ্বে অবস্থিত। অর্থাৎ প্লটটির তিন দিকে প্রশস্থ রাস্তা বিদ্যমান। এবং উক্ত প্লটের চার পাশে বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। আমি উক্ত প্লটটি রাজউক নির্ধারিত রূপান্তর ফিস প্রদান করে আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তর করতে আগ্রহী।
অতএব, উপরোক্ত প্লটের রূপান্তর (আবাসিক হতে বাণিজ্যিক) করণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ করা হলো।’
আবেদনটি সচিবের দপ্তর ডাইরী নং ৬০৪ তারিখ ২৫/১০/২০২১ ইং মোতাবেক এন্ট্রি হয়। পরবর্তীতে সচিব এ বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অতিরিক্ত সচিব মো. হেমায়েত হোসেন, উপ সচিব লুৎফুন নাহার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মুজিবর রহমানের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেন। এই কমিটি সরেজমিন তদন্ত করে গত ০৩/০১/২০২২ ইং তারিখে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেন যে, এই প্লটটির মাত্র ৪০ ফুট পশ্চিমে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব। যে ক্লাবে বিদেশী দূতাবাস কর্মকর্তারা সব সময় খেলাধূলা ও আচার অনুষ্ঠান করেন। এবং প্লটটির খুব সন্নিকটে অনেক দেশের দূতাবাস অবস্থিত। এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপত্তা বেষ্টিত। এ ছাড়া প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, প্লট সংলগ্ন এভিনিউ রোডে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাস, রাশিয়ান দূতাবাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত দূতাবাস, পাকিস্তান দূতাবাসসহ আরো অনেকগুলো দূতাবাস রয়েছে। রাজউকের স্কেচম্যাপ অনুযায়ী এটি একটি ডিপ্লোম্যাটিক জোন। এছাড়া প্লটটি রাজউক থেকে আবাসিক প্লট হিসাবে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং প্ল্যানও আবাসিক হিসাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এই তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে গণপূর্ত সচিব ডিপ্লোম্যাটিক জোনের নিরাপত্তা সংরক্ষণ, ট্রাফিক সমস্যা প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতে যাতে এটি একটি উদহরণ হিসাবে ব্যবহার না হয় সেসব কারণ উল্লেখ পূর্বক নথিটিতে আপত্তি দেন এবং এই প্লটটি রূপান্তর করা সমীচিন হবে না মর্মে ফাইল নোট দিয়ে গত ০৫/০১/২০২২ ইং তারিখে নথিটি প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে গত ২৮/০৪/২০২২ ইং তারিখে নথিটির ১৫০ নং অনুচ্ছেদে প্রতিমন্ত্রী দেশের স্বার্থে দেওয়া সচিবের আপত্তি উপেক্ষা করে তার একক সিদ্ধান্তে নথিটি অনুমোদন দেন। তিনি একজন প্রতিমন্ত্রী হয়েও দু’টি ভুল বানানে লেখেন: অনুচ্ছেদ ১৪৩ হতে ১৪৯ দেখলাম। নিয়াপত্ত্বায় পাশাপাশি ব্যবসা বানিজ্য প্রসারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ১৪৬ অনুচ্ছেদের প্রস্তাব অনুমোদন করা হলো। এটি লিখে তিনি ফাইলটি সচিবের কাছে পাঠিয়ে দেন। এরপর অটোসেটিক সেটি অনুমোদন হয়ে যায়। দেশের ডিপ্লোম্যাটিক জোনের নিরাপত্তার কথা না ভেবে কেন সচিবের মতামত উপেক্ষা করে অবিশ্বাস্য গতিতে নাভানা রিয়েল স্টেট লিমিটেডের এই নথিটি অনুমোদন দেওয়া হলো তার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিপুল অর্থের বিনিময়ে এই নথিটি পাশ করা হয়েছে। আর এর নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছেন প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব), হেমন্ত হেনরী, মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক, প্রতিমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হাবিবুর রহমান।
এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, ‘আমি সংসদে আছি। এখন ব্যস্ত। এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে পরে কথা বলবো।’ কিন্তু পরবর্তীতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি (শরীফ আহমেদ) এই বিষয়ে কোন কথা বলেননি।
এই বিষয়ে শহীদ উল্লাহ খন্দকার বলেন, আমি একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। আমি থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তি অনৈতিকভাবে সুবিধা নিতে পারবে না। দেশের স্বার্থে এবং ডিপ্লোম্যাটিক জোনের নিরাপত্তা এবং ট্রাফিক সমস্যার বিষয়টি মাথায় রেখেই আমি নথিতে আপত্তি দিয়েছি। একজন ব্যবসায়ীর জন্য তো আর গুরুত্বপূর্ণ ডিপ্লোম্যাটিক জোন হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারিনা।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকতা বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই এই গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম দেখছি। অনেক ফাইল আমাদের পর্যন্ত আসে না তাদের কাছেই থেমে যায়। আমাদের ‘সই’ তাদের প্রয়োজন নেই। ক্ষমতা বলে কথা। কখনো দেখি মন্ত্রীর দফতর থেকে ফাইল আসছে। কখনো দেখি সচিবের দফতর থেকে ফাইল আসছে। আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়েই মন্ত্রনালয় চলছে। কোন কিছু নিয়ে জামেলা তৈরি হলেই তখন সবাই জানতে পারে। তা নাহলে নীরবেই সমাধান।’
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা দু-জনেই প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকাকে সবাই ডিপ্লোম্যাটিক জোন হিসাবেই জানে। এই এলাকার নিরাপত্তা বিধানে সরকারের বিশেষ নজরদারি ও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। বিদেশী দূতাবাসগুলোর সন্নিকটে এভাবে যত্রতত্র বহুতলা বাণিজ্যিক ভবন অনুমোদন দিলে ডিপ্লোম্যাটিক জোনের নিরাপত্তা বলে আর কিছুই থাকবে না। যে কোন সময় আবার হলিআর্টিজিনের মত ঘটনা ঘটেতে পারে। তাই এসব নথি অনুমোদনের আগে এ বিষয়টি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
এছাড়া এতো বাণিজ্যিক অ-আবাসিক ভবনের কারণে এই সব ভিআইপি এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়ে বিদেশী দূতাবাসগুলোর কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা