অনলাইন ডেস্ক
চৈত্রের রুদ্র দিনের পরিসমাপ্তির মাধ্যমে গতকাল সোমবার ১৪২৬ সনকে বিদায় জানিয়ে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ মঙ্গলবার যুক্ত হয়েছে নতুন বছর। আজ পহেলা বৈশাখ। একটি নতুন বছরের শুভ সূচনা। শুভ নববর্ষ। স্বাগত ১৪২৭।
ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণে সন তারিখের প্রচলন মুসলিম শাসকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মহীশুরের শাসক টিপু সুলতান প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের বর্ষকে সূচনায় এনে বিশেষ রীতিতে ‘মুহাম্মদী সন’ প্রবর্তন করেন।
আকবরের ‘ফসলি সন’ গণনা রীতিতে চট্টগ্রাম ও আরাকানে প্রচলিত হয় ‘মগি সন’। পার্বত্য জনপদে ‘বৈসাবি’ নামে বর্ষবরণের রীতি প্রচলিত। পার্বত্য তিনটি উৎসবের আদ্যাক্ষর দিয়ে গঠিত শব্দ ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুক, বৈসু বা বাইসু ও মারমাদের কাছে সাংগ্রাই, অন্যদিকে চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত উৎসব হলো বাংলা নববর্ষ বা ‘বৈ.সা.বি.।
হিজরি সনের আদলে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত হয়েছিল ‘বিলায়তি সন’, ‘আসলি সন’, ‘ইলাহি সন’, ‘জালালি সন’ ইত্যাদি। এসব সন গণনা রীতির সঙ্গে প্রিয়নবী (সা.)-এর স্মৃতি ও ইসলাম-মুসলিম ঐতিহ্যের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত স্পষ্ট।
পহেলা বৈশাখ কীভাবে এলো!
ইতিহাস অনুসারে বাংলা সনের প্রবর্তনের সময় ধরা হয় ১৫৫৬ সাল থেকে, প্রবক্তা ছিলেন মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। ওই সালেই তিনি দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তাঁর সভাসদ জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীর সহযোগিতায় ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ বা ১১ মার্চ থেকে ‘তারিখ-এ-এলাহি’ নামে নতুন এক বছর গণনা পদ্ধতি চালু করেন।
সে সময়ের কৃষকদের কাছে এটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত হয়, যা পরে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই সময়ে প্রচলিত রাজকীয় সন ছিল ‘হিজরি সন’, যা চন্দ্রসন হওয়ার প্রতি বছর একই মাসে খাজনা আদায় সম্ভব হতো না।
এ কারণে সম্রাট আকবর একটি সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, যা কৃষকদের ফসল উৎপাদনের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। নতুন এই সাল আকবরের রাজত্বের ২৯তম বর্ষে চালু হলেও তা গণনা আরম্ভ হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকেই, কারণ ওই দিনেই দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে তিনি হিমুকে পরাজিত করেছিলেন।
বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে।
পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।
দেশ স্বাধীনের পর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীকে পরিণত হয় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছে।
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সার্বজনীন উৎসবে। পয়লা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারাদেশ। বর্ষবরণের এ উৎসব আমেজে মুখরিত থাকে বাংলার চারদিক।
গ্রীষ্মের খরতাপ উপেক্ষা করে বাঙালি মিলিত হয় তার সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে। দেশের পথে-ঘাটে, মাঠে-মেলায়, অনুষ্ঠানে থাকে কোটি মানুষের প্রাণের চাঞ্চল্য, আর উৎসব মুখরতার বিহ্বলতা।
নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করবে। সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে।
এদিকে, সোমবার বাংলাদেশে এক দিনে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১৮২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মোট ৮০৩ জনে দাঁড়াল। করোনা ভাইরাসে দেশে নতুন করে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হওয়ায় এ সংখ্যা ৩৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও তিনজনসহ মোট ৪২ জন করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েছেন।
এদিকে, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বে মৃতের সংখ্যা মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজারের কাছাকাছি।
বিশ্বব্যাপী ভয়াল আতঙ্ক করোনায় বাংলাদেশও আক্রান্ত। গবেষণা ও প্রতিরোধের সব প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে বাঁচার করুণ আর্তিতে দীর্ঘশ্বাস এখন সর্বত্র। মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে মুনাজাত “করোনা বর্ষ না হোক ১৪২৭ বঙ্গাব্দ’। বরং প্রত্যাশা—…মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা…” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রচনাকাল : ২০ ফাল্গুন ১৩৩৩, ৪ মার্চ ১৯২৭ খ্রি.)।
মহান আল্লাহ কষ্ট দেওয়ার জন্য বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেননি। করোনা সংক্রমণ মহান আল্লাহর পরীক্ষা। বাংলা নববর্ষেও মনে রাখতে হবে পবিত্র কোরআনের অভয়বাণী—‘…আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইয়ো না…।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৭)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হইয়ো না…।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)
যা-ই হোক, ঈমানি চেতনায় স্বাগত বাংলা নববর্ষ ১৪২৭।
Like & Share our Facebook Page
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা