শিশুদের তীব্র নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ডে-কেয়ার ব্যবস্থাপনা কার্যকর বলে জানিয়েছেন আইসিডিডিআর,বির গবেষকরা।
রবিবার (১ ডিসেম্বর) আইসিডিডিআর,বি সুইজারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ব্যাসেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেনটাকি-র সহযোগিতায় ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত এর সাসাকাওয়া মিলনায়তনে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা গবেষণার ফলাফল এর ওপর একটি সেমিনারে গবেষকরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
সেমিনারটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ডে-কেয়ার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিশুদের তীব্র নিউমোনিয়ার একটি উদ্ভাবনমূলক চিকিৎসা পদ্ধতি-সংক্রান্ত গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরেছে।
আইসিডিডিআর,বি-র নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্ল্যিনিক্যাল সার্ভিসেস ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. তাহমিদ আহমেদের উপস্থিতিতে আইসিডিডিআর,বি-র এমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ও গবেষেণাটির প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড. নুর হক আলম ২০১৫ থেকে ২০১৯ সময়কালে সংঘটিত এই গবেষণাটি সম্পর্কে তাঁর উপস্থাপনা তুলে ধরেন।
বিজ্ঞানীরা জানান যে, এই মডেলটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করে অক্সিজেন থেরাপি, ফ্লুইড, পুষ্টি ব্যবস্থাপনা এবং অ্যান্টিবায়োটিকের সমন্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত প্রচলিত চিকিৎসার ব্যবস্থার মতোই কার্যকর, নিরাপদ এবং বেশ ব্যয়সাশ্রয়ী। বাংলাদেশের বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে ডে-কেয়ার ধারণা ভিত্তিক নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনার এই পদ্ধতিটি বেশ সম্ভাবনাময়।
বিশ্বব্যাপী, প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা প্রায় ১২ কোটি বার নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, যার প্রায় ১০ ভাগ -এরও বেশি (১.৪ কোটি) তীব্র আকার ধারণ করে এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। উন্নয়নশীল দেশসমূহে শ্বসনতন্ত্রের নিম্নাংশের তীব্র সংক্রমণ (এ,এল,আর,আই), বিশেষ করে নিউমোনিয়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ, যা বছরে ৫০ লক্ষ মৃত্যু বা প্রতি পাঁচটি মৃত্যুর একটির দায়ী। বাংলাদেশে ২০১৮ সালে প্রতি ঘণ্টায় একটিরও বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়, যার ফলে ওই এক বছরে ১২,০০০-এরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয়।
উপরন্তু, শিশুদের অপুষ্টি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে এবং এটি নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় আশানুরূপ ফলাফল না পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
হাসপাতালে ভর্তি তীব্র নিউমোনিয়ার একটি অনুমোদিত চিকিৎসা ব্যবস্থা হলেও, বেশিরভাগ নিম্ন- ও মধ্যম আয়ের দেশে সাধারণত তীব্র নিউমোনিয়া বা অপুষ্টিতে আক্রান্ত সব শিশুর চিকিৎসা করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক শয্যা ও হাসপাতাল থাকে না।
এছাড়াও, অসুস্থ শিশুদের মায়েদের অন্যান্য শিশুর যত্ন ও সাংসারিক কাজের দায়িত্ব থাকে এবং এর ফলে তাঁরা ভর্তি শিশুর দেখভাল করতে সক্ষম হন না, যা হাসাপাতালে ভর্তি থাকার পুরো সময়টিতে অত্যন্ত জরুরী।
আবার, হাসপাতালে ভর্তির অন্যান্য সমস্যার মধ্যে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হাসপাতালে রোগীকে নেওয়ার পরিবহন ব্যয় এবং বাড়ীতে অন্য শিশুদের যত্নের অভাব বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা হিসেবে কাজ করে। তাই বিশ্বব্যাপী গুরুতর অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও যেসব শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয় না তাদের জন্য “ডে-কেয়ার মডেল”-এর মতো বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার ডিকিন ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের পিএইচডি শিক্ষার্থী ডাঃ মারুফা সুলতানা মডেলটির ব্যয় সাশ্রয়ী সম্ভাবনার দিকটির ওপর আলোকপাত করেন। পাথফাইন্ডার বাংলাদেশ-এর প্রাক্তন কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাডজাঙ্কট অধ্যাপক ড. হালিদা আক্তার এ-সংক্রান্ত অন্যান্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলসমূহ উপস্থাপন করেন, যেখানে দেখা গেছে, অপুষ্টিসহ বা ছাড়া তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত প্রায় ৯০ ভাগ শিশুর চিকিৎসা ডে-কেয়ার ক্লিনিকে নিরাপদভাবে করা যায়। বাংলাদেশ সাকারের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক ড. খালেদা ইসলাম কিভাবে এই মডেলটিকে সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সন্নিবেশিত করা যায় সেসম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন।
শিশুদের নিউমোনিয়ার ডে-কেয়ার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন একটি স্থাপনার যেটি সাধারণত বহির্বিভাগ পুনর্গঠন অথবা নতুন করে তৈরি, যেখানে শিশু শয্যা, রোগীর ওজন, উচ্চতা, প্রভৃতি নির্ণয়ের ব্যবস্থা, ন্যাসোফ্যারিনজিয়াল অ্যাসপিরেটস সাকশন, রক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশন পরিমাপ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ, রোগীর জন্য খাবার এবং দৈনিক দু’বার নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মীর দ্বারা রোগীদের ফলো-আপের ব্যবস্থা থাকবে।
এক্ষেত্রে, রোগীর প্রতি সতর্ক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও বহাল থাকা প্রয়োজন। অপুষ্টিসহ বা ছাড়া তীব্র নিউমোনিয়ার চিকিৎসার প্রচলিত ব্যবস্থার (হাসপাতালে ভর্তি) তুলনায় বাংলাদেশে বিদ্যমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে ডে-কেয়ার মডেলটির কার্যকারিতা যাচাই-সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেছে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও বেসরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এটি বেশ সম্ভাবনাময় এবং এই ব্যবস্থায় ব্যয় হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসা ব্যয়ের অর্ধেক।
তীব্র নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় ডে-কেয়ার মডেলটির বিভিন্ন সম্ভাবনাময় দিক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেনটাকি-র অধ্যাপক জর্জ ফুশ বলেন, “নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু, তাঁদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য ডে-কেয়ার মডেলটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি।”
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ গবেষণার উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, তীব্র নিউমোনিয়া চিকিৎসায় ডে-কেয়ার মডেল এর ধারণা একটি ভালো উদ্যোগ, ভবিষ্যতে দেশব্যাপী এই মডেলটির প্রসারের উদ্দেশ্যে আমরা শহর ও গ্রামাঞ্চলে এর পাইলট প্রকল্পের সম্ভাব্যতা খুঁজে দেখবো।
এছাড়াও, বাংলাদেশ পেডিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)-র সভাপতি অধ্যাপক (ড.) মঞ্জুর হোসেন এবং সুইজারল্যান্ডের ইউনিসেফ ফাউন্ডেশনের বোর্ডের সদস্য ড. ড্যানিয়েল ফ্রে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
আইসিডিডিআর,বি-র ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণকারীদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে এটির সমাপনী পর্বের ইতি টানেন।
ইউনিসেফ, ইউবিএস অপটিমাস ফাউন্ডেশন, বটনার ফাউন্ডেশন, ইগল ফাউন্ডেশন, আইসিডিডিআর,বি এবং বাংলাদেশ সরকার গবেষণাটি পচিালনায় সহায়তা করেছে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা