অনলাইন ডেস্ক
বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নিজের ভিজিটিং কার্ডও দেন আফরিন। এরপর তার কথায় প্ররোচিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য রেখে টাকা তুলে দেন বিপ্লব। কিছুদিন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সেখানে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় অফিস সহকারী পদের নিয়োগপত্র। এরপর টানা তিন মাস ১১ হাজার টাকা করে বেতনও পান বিপ্লব। যদিও সেই টাকা আফরিন সুলতানা নিজের হাতে দিতেন। কারণ হিসেবে বলতেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না করা পর্যন্ত বিপ্লব এভাবেই বেতনের টাকা পাবেন।
সরকারি চাকরি পেয়েছেন, এমন সংবাদে বিপ্লবের কাছে অনেকেই চাকরির তদবির নিয়ে আসেন। আফরিন সুলতানাও বিপ্লবকে বলেন, টাকা দিলেই দিতে পারবেন চাকরি। এভাবে বিপ্লবের কয়েকজন স্বজনও চাকরির জন্য টাকা দেন আফরিন সুলতানার হাতে। তবে তারা কেউই চাকরি পাননি। এখন ফেরত পাচ্ছেন না টাকাও।
কালবেলার সঙ্গে আলাপে বিপ্লব বলেন, ‘আমি সব হারিয়েছি। ধারদেনা করে চলছি। পাওনাদারদের ভয়। ব্যবসা নেই। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। সেই কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। সংসার-সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি; কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। এখন উল্টো হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।’
ভুক্তভোগীদের আরেকজন সায়েম। তিনিও তিন মাস বেতন পেয়েছেন আফরিন সুলতানার থেকে। তার ভাষ্য, ‘কয়েক দফায় প্রায় তিন লাখ টাকা দিয়েছি আফরিন সুলতানার কাছে। প্রথম দফায় এক লাখ টাকা দেওয়ার পরে বিভিন্ন ভাগে বাকি টাকা দিয়েছি।’
সায়েম বলেন, ‘আফরিন সুলতানার জুনিয়র পরিচয়ে ফরহাদ নামের একজন ফোন করতেন। টাকার জন্য দিতেন তাগাদা। বলতেন, সব টাকা পরিশোধ করতে পারলেই পরের দিন মিলবে চাকরি। এমনকি আমাকে দিয়ে অফিসিয়াল ড্রেসকোডের জন্যে নতুন প্যান্ট-শার্ট কেনায়। কিন্তু চাকরি আর পাইনি। টাকা ফেরত চাইলেও সেই টাকা আর দিচ্ছেন না। দিনের পর দিন ঘুরছি। আমার একজন নিকটাত্মীয়ও তাকে চাকরির জন্য টাকা দিয়েছে।’
প্রতারণার শিকার মাসুদ কালবেলাকে জানান, ‘আমি নিজের চাকরির জন্য ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। কথা ছিল কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেবেন। এরপর আমার আরেকজন আত্মীয় দেন ৬০ হাজার। তাকে পিয়ন পদে চাকরি দেওয়ার কথা ছিল। এখন চাকরিও নেই, টাকাও ফেরত পাচ্ছি না।’
বিভিন্ন কাগজপত্র, ফোনকল রেকর্ড, ইমো এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিংয়ের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড আফরিন সুলতানা নামের এক নারী। লালবাগের পুরোনো পলাশী এলাকায় বাসা তার। তবে এখন ভাড়া থাকেন চকবাজারের হরনাথ ঘোষ রোডে।
গতকাল সরেজমিন পুরোনো পলাশী এলাকা ঘুরে আফরিন সুলতানা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়। এলাকার কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, এলাকার সবাই জানে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট। প্রাইভেটকারের সামনে ম্যাজিস্ট্রেট লিখে এলাকা দাপিয়ে বেড়ান। অনেককেই চাকরির আশ্বাস দেন। তবে এলাকার কেউ চাকরি পেয়েছে, এমন তথ্য দিতে পারেননি তারা।
বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণের জন্য ভুক্তভোগীদের দেখানো আফরিন সুলতানার ভিজিটিং কার্ডে রয়েছে বেশ কিছু অসংগতি। কার্ডের ‘মেম্বারস’ এবং ‘ডেজিগনেশন’ বানান ভুল। এ ছাড়া যে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে, তা সরকারি চাকরির অন্যান্য নিয়োগপত্রের মতো নয়।
চাকরির নামে প্রতারণার এই চক্রে আফরিন সুলতানার সঙ্গে আছেন ফরহাদ হোসেন ওরফে রিঙ্কু। ভুক্তভোগীরা জানান, নিজেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আফরিন সুলতানার জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন ফরহাদ। চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং দেনদরবারের বিষয়টি দেখেন এই ফরহাদ। এভাবে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকার নেওয়ার বেশ কিছু প্রমাণও পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে ফরহাদ হোসেনকে ফোন দিলে তিনি প্রথমে কথা বলেন। তবে ভুয়া চাকরির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ফরহাদ নয় বলে জানান। এরপর নিজেকে রিঙ্কু হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই। সবকিছু আফরিন ম্যাডাম বলতে পারবেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ম্যাজিস্ট্রেট।’
জানা যায়, ভুয়া চাকরি দেওয়ার এ সিন্ডিকেটে বেশ কয়েকজন সদস্য রয়েছেন। এরা তুলনামূলক সহজ-সরল এবং অসহায় মানুষদের খুঁজে বের করে চাকরির প্রলোভন দেখান। আর সেই ফাঁদে পা দিলেই হাতিয়ে নেন টাকা। পরে ভুক্তভোগীরা টাকা ফেরত চাইলে দেওয়া হয় হুমকি-ধমকি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আফরিন সুলতানা প্রথমে নিজেকে ‘ম্যাজিস্ট্রেট’ এবং পরে ‘জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট’ হিসেবে পরিচয় দেন। প্রথমে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নন-ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার কথা বললেও পরে আবার নবম বিজেএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিয়েছেন বলে জানান।
তার দেওয়া তথ্যমতে, পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগে; কিন্তু অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করে কীভাবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এর আগে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটি থেকে আইনে পড়াশোনা করেছি। সম্ভবত ২০১৪ সালের দিকে আমাদের বিজেএসসি পরীক্ষা হয়েছিল।’ যদিও তিনি দাবি করেন, কলকাতা থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন ২০১৬ সালে। তিনি বলেন, আমি শুরুতে সুপ্রিম কোর্টে ছিলাম, এরপর পদোন্নতি পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করি। তবে এখন ছুটিতে রয়েছি।
চাকরিতে নিয়োগের কথা বলে প্রতারণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কয়েকজনের সঙ্গে সুসম্পর্কের সূত্রে চাকরির কথা বলেছি। তবে চাকরি দিতে না পারলে টাকা ফেরত দিয়েছি। ধরেন, ২০ জনের কাছ থেকে টাকা নিলেও ১৬ জনেরটা ফেরত দিয়েছি।’ নিয়োগপত্র এবং বেতন দেওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন। এরপর আবার বলেন, ‘হ্যাঁ, চাকরি দিয়েছিলাম। পরে বিশেষ কারণে আবার বাতিল করে দিয়েছি।’
অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগীর পাওনা ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মোহাম্মদ বিপ্লব নামের এক ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করেন। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট কর্মকর্তাদের তালিকায় আফরিন সুলতানা নামে কোনো কর্মকর্তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। যোগাযোগ করে জানা গেছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আফরিন সুলতানা নামে কোনো কর্মকর্তা নেই। এমনকি এই মন্ত্রণালয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কারও পদায়নও হয় না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন রেজা কালবেলাকে বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বলে কোনো পদই নেই।’
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা