শেখ মো. শিমুল
দেখতে এমনটাই মনে হবে, পোষ মাসের শীতের ঘন কুয়াশায় ঘেরা কোন এক বিকেলের দৃশ্য! কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে পুরো এলাকা জুড়ে। কিন্তু এমনটি নয়! এটি নদী বেষ্টিত মুন্সীগঞ্জ জেলার ধলেশ্বরী নদী তীরবর্তী গড়ে উঠা অসংখ্য সিমেন্ট ফেক্টরী হতে নির্গত ভয়ঙ্কর ডাস্ট। ফেক্টরীগুলিতে সিমেন্ট তৈরীর কাঁচামাল অর্থাৎ ক্লিংকার বাতাসে মিশে পুরো এলাকা জুড়ে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।এযেন নিত্যদিনের দৃশ্য। পরিবেশের এ ভয়ানক বায়ু দূষণের কবলে পড়ে এর কালো থাবায় শিশুসহ জেলার সব বয়ষী মানুষের জীবন গ্রাস করে নিচ্ছে এ বিষাক্ত ক্লিংকার। এ ক্লিংকার বাতাসের সঙ্গে মিশে শ্বাসপ্রশাসে ঢুকে নানাবিধ ব্যধিসহ হুমকিতে রয়েছে জেলার মানুষের ভবিষ্যৎ। হুমকিতে রয়েছে সভ্যতার এই জনপদ। নদীর তীরবর্তী গড়ে উঠা অসংখ্য স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থী এ দুষিত পরিবেশেই লেখা-পড়া করছে। এবং স্থলপথ ও নৌপথে আসা এই শিক্ষার্থীরা নাক চেপে ও মাক্স পড়ে কোনরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে লঞ্চে ও সড়ক পথে চলাচল করতে হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল ও গাছ-পালা। প্রতিটা প্রাণী বাঁচে পরিবেশে। নদীর পানি দুষিত হয়ে নষ্ট হচ্ছে মাছের জীববৈচিত্র।
বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, বিজ্ঞানী, গবেষক, লিখক, কবি, সাহিত্যক, কৌতুকার, অভিনেতা, শিল্পী, মনিষী, মোঘল আমলের ভারতবর্ষের রাজা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ রয়েছে বিভিন্ন পুরাকীর্তি, নিদর্শন ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের এই জনপদ বিশ্বজুড়ে খ্যাত। এতো ঐতিহ্যপূর্ণ এ জেলার পরিবেশ দূষণে মানুষের জীবন হুমকিতে পড়েছে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রের অদূরে পশ্চিম মোক্তারপুর জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অনিয়ন্ত্রিত ভাবে গড়ে উঠা এসব সিমেন্ট ফেক্টরী। মানুষের সুরক্ষার কথা না ভেবে জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন ভাবে ডাস্ট, ক্লিংকার, ধোঁয়া ও বর্জ নির্গমন করে যাচ্ছে। এ এলাকার মানুষের বসবাস করাই এখন দায় হয়ে পড়েছে। এ এলাকাসহ আশে-পাশের জেলা শহর, পঞ্চসার, নয়াগাঁও, মোক্তারপুর, মালিরপাথর, রিকাবিবাজার, বিনোদপুর, হাটলক্ষিগঞ্জসহ জেলার সবত্র বাতাসের সাঙ্গে মিশে যাওয়া এ ডাস্ট ও ক্লিংকার জেলার মানুষ নানাবিধ রোগসহ স্বাস্থ্য ঝুাঁকতে পড়ছে। দেখা দিচ্ছে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীর প্রদাহ, ফুসফুসের রোগ, মাথা বেথা, সাইনোসাইটিস, মাইগ্রেন, জ্বর, কাশি, গলা দিয়ে রক্ত পড়া, হাঁপানী, চুলকানি, শরীরে গোটাসহ ত্বকের রোগ, বক্ষ সংক্রান্ত রোগ, টিবি ও বিভিন্ন ধরনের মরণব্যাধি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছে এ এলাকার জনগণ। দিন দিন রোগাক্রান্ত হয়ে এসব এলাকার মানুষ শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্রমশ।
বিভিন্ন ফেক্টরীর বর্জ নদীতে পড়ে নদীর পানি দূষণ হচ্ছে। নদীর টলমলে পানি গল্পে পরিনত হয়ে এখন দূষিত দূর্গন্ধ বেরুচ্ছে। মৎস প্রাণীরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে দেখা দিচ্ছে মৎস সংকট। নষ্ট হয়ে গেছে মাছের রঙ ও স্বাদ।
একদিকে সিমেন্ট ফেক্টরীর ডাস্ট অপরদিকে কলকারখানার কালো ধোঁয়া, জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠা অবৈধ ইটভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে ব্যপক হারে ক্ষতি করছে ফসলেরও। এসকল ডাস্ট গাছের পাতায় পড়ে পাতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলজ গাছের ফল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে গাছপালা, ফল ও সজবি গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে অনের গাছ মরে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, সিমেন্ট ফেক্টরীগুলি থেকে ডাস্ট, ক্লিংকারের পাশাপাশি যখন বিষাক্ত গ্যাস বের হয় তখন চোখ দিয়ে তাকাতে যায়না। চোখ জ্বালাপোড়া করে, কাশি হয়, নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। এ এলাকায় শিশু ও বয়ষ্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, শ্বাসনালীর প্রদাহ, ফুসফুসের রোগ, ব্রংকাইটি, হাঁপানী, চুলকানি ও ক্যান্সারসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফেক্টরী থেকে যে শব্দ বেড় হয় তাতে মানুষ ঘুমাতে পাড়ে না। এতো জনবসতিপূর্ণ এলাকায় লোকজনের বসবাসে এখন অনুপযোগী হয়ে দাঁগিয়েছে। এ বিষয়টি আমরা ফেক্টরীর কর্তৃপক্ষদের দৃষ্টিতে দেয়ার চেষ্টা করলেও তারা এ বিষয়টি কোন আমলেই নেন না।
তারা আরো জানান, এসব কষ্ট সহ্য করতে না পেরে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অনেকেই সম্পত্তি বিক্রি করে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেকেই আবার চলে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছেন। আর এই সুযোগ নিয়ে ফেক্টরীর মালিকরা বিক্রয়ের সম্পত্তি কিনে তারা তাদের ব্যবসার বিস্তার ঘটাচ্ছে। এ যেন কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। এমনটি চলতে থাকলে এ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের বসবাসের কোঠা কমে যাবে। হারাবে তাদের স্মৃতিবিজরীত ভিটেমাটি।
মানবদেহের ক্ষতির বিষয়ে ঢাকা জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডাঃ মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, সিমেন্টের ক্ষুদ্র কনা দীর্ঘ দিন শ্বাসনালীতে গেলে ফুসফুসের ভয়াবহ রোগ যেমন- নিউমোকোনোসিস, সিলিকোসিস, ক্যান্সার হতে পারে।
তিনি আরো জানান,সিমেন্টের কনা হতে পাকস্থলী ও বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার হয়। এই কণা ত্বকের প্রদাহ করে।
মুন্সীগঞ্জ নাগরিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট সুজন হায়দার জনি বলেন, ধলেশ্বরী নদীর পানি স্বচ্ছ ও নদীটি বৈচিত্র্যময় ছিল। এ নদীর তীরবর্তী মানুষ নদীর পানি বাড়ির রান্নার কাজসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতো। বহুপ্রজাতীর মাছের চাহিদা মেটাতো এ জেলার মানুষ। সিমেন্ট ফেক্টরীসহ বিভিন্ন কারখানার বর্জে পানি দূষিত হয়ে দূর্গন্ধ বের হচ্ছে। নদীরতীরবর্তী এসকল সিমেন্ট ফেক্টরীগুলির বড় পরিসরে আগ্রাসনে নদীর নাব্যতা হারাতে পারে। এর ডাস্টে এ অঞ্চলের মানুষের ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। এব্যপারে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নিরুত্তর কুমার সরকার জানান, আশপাশের অসংখ্য সিমেন্ট ফেক্টরী ডাস্ট, ইটভাটা সহ বিভিন্ন কালকারখানার ধোঁয়া গাছের অনেক ক্ষতি করে। সিমেন্টের ডাস্ট ও ধোঁয়া গাছের পরাগায়ন নষ্ট হয়ে যায়। গাছের পাতা থেকে গাছ খাদ্য তৈরি করে। সিমেন্ট ফেক্টরীর নির্গত ডাস্ট পাতায় পড়ে এর মধ্যে ভোরের শিশির পড়ে পতার উপর জমাট বেঁধে যায়। ফলে গাছ তার খাদ্য তৈরি করতে না পেড়ে অনেক গাছ মারা যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসকল সিমেন্ট ফেক্টরীর নির্গত ডাস্ট ও ইটভাটা সহ কলকারখানার ধোঁয়ায় পরিবেশ ও গাছ-পালা, কৃষি ফসলের ব্যপক ক্ষতি হচ্ছে। এ ব্যপারে আমরা জেলার সমন্যয় পরিষদের মিটিংয়ে আলোচনায় বার বারই বলে আসছি। আমরা কি করবো?
এ ব্যপারে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা নিবাহী কমকতা(ইউএনও)মোঃ ফারুক আহম্মেদ জানান, আামাদের কিছু করার নেই। এ ব্যপারটি সম্পূর্ণ পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা যদি ভ্রাম্যমাণ আদালত বা কোন ব্যবস্থা নিতে চায় তাহলে আমরা তাদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে সহযোগিতার করবো।
এব্যপারে মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ নয়ন মিয়া মানবদেহসহ পরিবেশের ক্ষতির বিষয়টি স্বীকার করে জানান, এসকল সিমেন্ট ফেক্টরীগুলো অাধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করছে না। তারা সে পরিমানের টাকা ব্যয় করছে না। এর জন্যে প্রথমত প্রয়োজন ইকোহেপার যার মূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী ইকোহেগার, সেন্টিফিউগার টাওয়ারের, ডাস্ট কালেক্টর বেগফিল্টার, গ্রেভিটেশনাল চেম্বার ব্যবহার করা প্রয়োজন। এসকল অাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে কোনমতেই ডাস্ট বাহিরে যাবো না। তারা সীমিত আকারে ডাস্ট কালেক্টর বেগফিল্টার ব্যবহার করলেও তা প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট নয়।
তিনি আরো জানান, তাদেরকে আমরা এনফোর্সমেন্টের আয়োতায় এনে অার্থিক জরিমানা করছি। তারা জরিমানা দিয়ে আদালতে রিট করে পড়পেয়ে যায়। তাদেরকে বারবার জরিমানায় এনে সতর্ক করেও আধুনিক ব্যবস্থাপনায় আনতে পারছিনা।
তবে এ সিমেন্ট ফেক্টরীগুলি ডাস্ট ও ক্লিংকার যেনো উড়ে গিয়ে বাতাসে মিশে না যায়, সেব্যপারে বিজ্ঞান সম্মতভাবে আধুনিক পদ্ধতি স্থাপন ও পর্যাপ্ত ডাস্টার ব্যবহারসহ এ ব্যপারে কর্তৃপক্ষের দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহণ এখন সময়ের দাবী বলে মনেকরেন অনেকে
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা