All-focus
ড. ইকবাল হুসাইন
আজ ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। জাতীয় পর্যায়ে মুজিববর্ষ পালনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে আজ থেকেই। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের শতবছর পূর্তি। এ উপলক্ষে সরকার ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ ঘোষণা করেছে। যে মহামানবের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না তাঁর জন্মশতবার্ষিকীকে স্মরণীয় করে রাখতেই এ উদ্যোগ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও নানা আয়োজনে মুজিববর্ষ পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি অতিথিমণ্ডলীর উপস্থিতিতে বর্ণাঢ্য সব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বছর জুড়ে আমরা জাতির জনককে স্মরণ করবো, শ্রদ্ধা জানাবো, তাঁর দর্শন ও আদর্শের সাথে আরো বেশি করে পরিচিত হবো, তাঁকে নিবিড়ভাবে জানবো আর প্রাণভরে ভালোবাসবো। তবে মুজিববর্ষের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, তিনি যে বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখতেন তা নির্মাণের ব্রত গ্রহণ করা।
শেখ মুজিবের ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠার মূলে ছিল বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন। তাঁর রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল দরিদ্র এবং শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন। তাঁর দর্শন ছিল সব মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সমান সুযোগ তৈরি। গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সমসাময়িক অন্য যেকোনো রাজনীতিক থেকে ছিল স্বকীয়, স্বতন্ত্র এবং দৃষ্টান্তমূলক। সাংগঠনিক দক্ষতা, সংগঠনের প্রতি অঙ্গীকার এবং কর্মীদের প্রতি তাঁর দরদ ছিল প্রবাদতুল্য। যে বিষয়টিতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তা হলো মাটি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা। দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেমই তাঁকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির অভিধায় ভূষিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সবথেকে ভালো উপায় হচ্ছে তাঁর এসব গুণাবলি ধারণ করা, চর্চা করা।
১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই আমাদের বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় ৯৪ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলারে। কৃষির পরিবর্তে শিল্প এবং সেবাখাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে। নগরায়ণের পাশাপাশি মানুষের জীবন মানের উন্নতি হয়েছে। গবেষণা বলছে, উন্নয়নের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৪ সালের মধ্যে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৫তম দেশ। নিঃসন্দেহে এগুলো আমাদের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির পরিচায়ক। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের দেশ। বঙ্গবন্ধু সবসময় সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের জন্য নানাবিধ সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের জীবনে ঊর্ধমুখী গতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ এবং গ্রাম ও শহরের বৈষম্য হ্রাস করতে পারলে সামাজিক বৈষম্য কমে আসবে। পাশাপাশি দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন রোধে কঠোর এবং কার্যকর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। মানুষ যাতে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়তে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। ক্যাসিনো এবং ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি আশান্বিত করেছিল। কিন্তু অভিযানে স্থবিরতা মানুষকে আবার হতাশ করছে। দু’একজন সম্রাট কিংবা জি.কে শামীমকে ধরার মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযানকে সফল বিবেচনা করার সুযোগ নেই। প্রতিটি সেক্টরেই এরূপ অসংখ্য সম্রাট-শামীম আছেন। সবাইকেই আইনের আওতায় আনতে হবে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক কাউন্সিলর দলের পক্ষ থেকে আবার মনোনয়ন পেয়েছেন। এটি প্রত্যাশিত ছিল না। তবে একটি শুদ্ধ সমাজ গঠনের দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের যে যেখানে আছি সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু কখনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আমরা কেউই দুর্নীতি, চাঁদাবাজী, অর্থআত্মসাতের মত গর্হিত কাজ করতে পারি না।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে সরকারকে সুশাসনের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। যে সমাজে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা যথাযথ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পায় না সে সমাজের সব অর্জন ও উন্নয়ন অর্থহীন। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ঘটনা কাদাচিৎ। তার অর্থ হচ্ছে, বেশির ভাগ ধর্ষণের ঘটনায় কোনো শাস্তি হয় না! খুন, হত্যা, অপহরণ, নারী নির্যাতন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজীসহ অধিকাংশ অপরাধের ক্ষেত্রে প্রায় একই চিত্র। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে সভ্যতা আমাদেরকে ভ্রুকুটি করবে। ভিন্নমত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এ বিতর্কেরও অবসান হওয়া প্রয়োজন। মুজিববর্ষের অন্যতম অঙ্গীকার হতে পারে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করা।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি কম নয়। সাক্ষরতা ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি, ছেলেমেয়ের অনুপাত, ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস প্রভৃতি সূচকে বাংলাদেশের অর্জন প্রসংশনীয়। কিন্তু বৈশ্বিক অগ্রগতি এবং প্রতিযোগিতায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক পিছিয়ে। প্রযুক্তিভিত্তিক এবং কর্মমুখী শিক্ষার অভাবে তরুণ সমাজে বেকারত্ব এবং হতাশা বাড়ছে। উৎপাদনমুখী, দক্ষতামূলক এবং সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন অসম্ভব। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সর্বত্রই সমান নজর দিতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে খরচ এবং সুযোগের যে বৈষম্য রয়েছে তা নিরসন করে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে আধুনিক, উন্নত এবং সমতাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন হতে পারে মুজিববর্ষের প্রধান অঙ্গীকার।
বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় রাজনীতির কবি। বস্তুত রাজনীতির চিত্রপটে তিনি যে ছবি এঁকে গেছেন সমসাময়িক বিশ্বে তার দৃষ্টান্ত বিরল। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি মনোভাব ও শিষ্টাচার, বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণুতা, সতীর্থদের প্রতি দরদ ও দায়িত্ববোধ, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনুকরণীয়, অনন্য এবং অসাধারণ। আজ আমরা অনেকেই মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলি, কিন্তু অন্তরে তার দর্শন ও আদর্শ লালন করি না। এমনকি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত অনেকের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণের বিশাল ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। আওয়ামী লীগ টানা এগারো বছর রাষ্ট্রক্ষমতায়। এ সময়ে পদ-পদবী, অর্থবিত্ত এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির লোভে অনেকেই দলে ভিড়েছেন। অসাধু নেতাদের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী লোকজনও আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে। এদের অনেকেই দলের ভিতর শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন; কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন অনেক ত্যাগী ও আদর্শবান নেতা-কর্মী। মুজিব-অনুরাগীদের আশা, মুজিবর্ষেই দল এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবে। ক্ষমতার জোরে যারা বিভিন্ন সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত ঘৃণ্য অপরাধের সাথে জড়িত দলীয় পরিচয় যা ই হোক তাদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করে গেছেন। আমাদের কোনো আচরণ ও কার্যক্রম দ্বারা তাঁকে ছোট করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। অতীতে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন কিংবা শাহাদৎ বার্ষিকীতে চাঁদাবাজী, কাঙালিভোজে মারামারি ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়েছে। মুজিববর্ষের কোনো কর্মসূচিতে এরূপ কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি কাম্য নয়। কেবল মুজিববর্ষের কর্মসূচি নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং তার আদর্শ অনুসরণ একটি সর্বজনীন বিষয়। মুজিব একটি দর্শন, একটি বিশ্বাস। ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত ও অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চা করার বিষয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি যদি সত্যিই আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকে তবে আমরা দুর্নীতি করতে পারি না, দেশের স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করতে পারি না, নির্বাচনে কারচুপি করতে পারি না, মানুষকে কষ্ট দিতে পারি না, অপরকে ঠকাতে পারি না। কারণ বঙ্গবন্ধুপ্রেম, দেশপ্রেম এবং মানবপ্রেম সমার্থক!
ড. ইকবাল হুসাইন, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
ihusain1979@gmail.com, ০৯ জানুয়ারি ২০২০।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা