নিজস্ব প্রতিবেদক: আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ কতদূর চলিবে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থও ভিন্ন নহে_ একই।” বেগম রোকেয়া কতকাল আগে বলে গিয়েছিলেন কথাটি। অথচ এখনো আমরা তা যথার্থ অনুধাবনে ব্যর্থ। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যই নারী পুরুষ উভয়ের উন্নতি প্রয়োজন। সেই উন্নতির প্রথম ধাপ– শিক্ষা। কেবল একাংশ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের সোপানে পৌঁছানোর চেয়ে সম্পূর্ন অংশ নিয়ে এগিয়ে গেলে সহজেই পৌঁছানো সম্ভব। বাহ্যিক সৌন্দর্য বর্ধনে রঙের প্রলেপ আর অলঙ্কারসজ্জিত হয়ে অন্যের মনোরঞ্জনে মনোনিবেশের চেয়ে, জ্ঞানের আলো দিয়ে অন্তরসজ্জা করলে আত্মিক এবং বাহ্যিক উভয় সৌন্দর্যই রক্ষা হয়।
নারীর নিজেকেই নিজের ভেতর আলো নিয়ে আসতে হবে, নইলে কেউ তার অন্ধকার পথে আলো জ্বেলে দেবে না। নারী পুরুষ উভয়ই এক পৃথিবীর সহযাত্রী –মানুষ। এই মানুষের একাংশ নারী। যে নারী পরিবার থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়ে পদে পদে নানারকম বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে তার জীবনের চাকা ঘুরতে ঘুরতে একসময় নিঃশেষ হয়ে যায়। নারী নয়, প্রত্যেক মানবসন্তান কেবল মানুষ হোক। নারী নিজেই নিজের ভেতর আলো নিয়ে আসুক। বোধ ও বিবেকের সহজ উন্নত বিস্তারে আমার লেখার জগতে ‘নারী’ একটি বিশেষ অধ্যায়। আমি প্রতিনিয়ত পাঠ শিখি এই জগত ও জীবনে। পিতার ঘর থেকে স্বামীর ঘর, শিক্ষাজীবন,কর্মজীবন , লেখক কিংবা সৃজনশীলতার যেকোনো অঙ্গন, ভিক্ষুক কিংবা কারখানার শ্রমিক, নারীর চলার পথ কখনো মসৃণ নয়। দ্বিধা এবং ভয়কে দূরে ঠেলে এই দুর্গম পথের সত্য ঘটনা উঠে এসেছে মেঘ_জলের_জীবন এ।
‘প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে রোজ রাতে চাচির কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। আওয়াজেই বোধগম্য হতো কান্নাটাকে যথাসম্ভব শব্দহীন করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে প্রহারের প্রচন্ডতায় আর্তনাদের শব্দ বাইরে বেরিয়ে আসতো। সেই আর্তচিৎকার আর কাতরতা আমার অন্তর্ভেদ করে আমাকেও চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে কত। মাঝরাতের সেই কান্নার সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় ছিল। জানতাম সেই বাড়ির চাচা মধ্যরাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরতেন……” ’ছোটবেলায় একদিন দেখলাম রোকেয়া অপরাধী না হয়েও শাস্তি পেল। চরম অপমান আর অপবাদ দিয়ে তার কিশোরী মনটাকে কাঁটাতারের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে জীবনটাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেওয়া হলো।
বয়সে রোকেয়া আমার থেকে তিন-চার বছরের বড় হলেও আমরা ছিলাম সহপাঠী এবং খেলার সাথি। রোকেয়ার সাথে তার পরিবার এবং সমাজের ব্যবহার আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল নারীর জন্য এই পৃথিবীটা সহজ এবং সমান্তরাল নয়….’। ‘পাঁচটি সন্তান স্বাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বৃদ্ধবয়সে মা আয়েশা খাতুনের ঘরে ঠাঁই হয় না। স্বামীর ঘরেও নিজেকে পরবাসীর মতো জীবনের শেষ দিনগুলো চরম কষ্টে অতিবাহিত করতে হয়। নিজে না খেয়ে যেই সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিয়ে পাখর ছানার মতো বড়ো করে তুলেছিলেন সেই সন্তানদের কাছে মা এখন বোঝা…আমার আহত মত জীবনের এক অনিশ্চিত অধ্যায়ের ভাবনায় কাতর হয়ে ভাবে-কোথায় আমার মা! আমিও একদিন মা হব, বৃদ্ধ হব’! বেড়ে উঠতে উঠতে দেখা জীবনের আনাচ-কানাচ মনের দরদ নিয়ে, কষ্টের বাষ্প দিয়ে, আবেগের কালি দিয়ে আঁকা আমার ভাবনাগুলো কাগজে নেমে আসতে থাকলো নিঃশব্দে… নারীর জীবনের মেঘ, অন্তরপোড়া দহনের বাষ্প থেকে নেমে আসা জলের গল্প নিয়ে “” মেঘ-জলের জীবন “”” একটি বইয়ের বা জীবনের কতটুকুই বা তুলে ধরে যায়, তবু চেষ্টা করলাম কিছুটা। মেঘ- জলের জীবন বই থেকে আংশিক তুলে ধরলাম পাঠকদের জন্য। এরকম হাজারো নারীর জীবনের সত্য এবং নির্মম ছবি নিজের ক্ষুদ্র যোগ্যতায় তুলে ধরেছি। আছে কিছু সফলতারও অবিশ্বাস্য গল্প। বইটিতে কন্যাশিশু থেকে নারী হয়ে ওঠা এবং নারী জীবন অতিবাহিত হওয়ার শেষবেলা পর্যন্ত নারীর জীবনের অসংখ্য না বলা হাহাকার, বেদনা, জমে থাকা মেঘের বাষ্প অশ্রুবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার সত্য ঘটনাগুলো লেখা হয়েছে।
মেহেরুন নেছা রুমার এটি ১০ম বই। এই বইয়ের অনেক লেখা ইতোমধ্যে জাতীয় পত্রিকা দৈনিক সমকাল, যুগান্তর, ভোরের কাগজ, দৈনিক সংবাদ এ প্রকাশিত হয়েছিল। মেহেরুন নেছা রুমা বলেন, অল্পকালের এই জীবনে দেখা এবং অভিজ্ঞতার ওজন খুব কম নয় তারই প্রেক্ষিতে আমার এই জগত ও জীবন নিয়ে ভাবনার প্রতিফলন। শুধু লেখার জন্যই লেখা নয়, লেখার মাধ্যমে সমাজ ও ব্যক্তির বিবেক ও বোধের জগতে আলো আসুক, এটিই আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস। মেহেরুন নেছা রুমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কালিকাপুর নামক এক ছোট্ট গ্রামে।
বই : মেঘ- জলের জীবন
লেখক : মেহেরুন নেছা রুমা
প্রকাশনি : অনিন্দ্য
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
প্যাভিলিয়ন : ৩১ একুশে বইমেলা ২০২০