ফজলুল বারী
অস্ট্রেলিয়ার দাবানল এবার বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে দাবানল তথা বুশ ফায়ারে মারা গেছেন ২২ জন। দেড়শ’র মতো বাড়িঘর পুড়েছে। ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা থেকে শুরু করে প্রানী মারা গেছে পঞ্চাশ কোটির বেশি। ক্যাঙ্গারু-কোয়ালা এরা সাঁতার কাটতে জানেনা বলে এরা অস্ট্রেলিয়ার বাইরেও যেতে পারেনা। উল্লেখ্য চারপাশে সমুদ্র পরিবেষ্টিত অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কারও স্থল সীমান্ত নেই। কমপক্ষে ৬০ লক্ষ হেক্টর জমির বনভূমি পুড়েছে এই দাবানলে। পুরো ক্ষয়ক্ষতির নিরূপনের কাজ এখনও চলছে। তবে প্রানী সহ পরিবেশের এমন কিছু ক্ষতি হয়েছে যা কোনদিনই পূরন হবেনা। দাবানলের পর এখন অস্ট্রেলিয়া বন্যার ঝুঁকিতে! দাবানল এলাকাগুলোয় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আগামী শনি-রবিবার পর্যন্ত যে পরিমান বৃষ্টির আভাস দেয়া হয়েছে তাতে বন্যার আশংকা করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ এলাকায় ফ্লেশফ্লাড তথা বন্যা অবশ্য আসে আর যায়। সেভাবে স্থায়ী হয়না। তবে যে এলাকা দিয়ে বন্যা পানি গড়িয়ে যায় সে এলাকার রাস্তা মেরামত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট রাস্তা বন্ধ রাখা হয়।
দাবানল নিয়ে বাংলাদেশ থেকে উদ্বেগের অনেক ফোন পেয়েছি প্রায় দিন। ভালোবাসার উদ্বেগ। কারন মাঝে মাঝে বাংলাদেশের কোন কোন টিভি চ্যানেলে এমনও রিপোর্ট হয়েছে যে সিডনি থেকে মানুষজন নাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছে! এই টিভিওয়ালারা আমাদের একটু ফোন করলে এই ভুল করতেননা। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বাংলাদেশের চেয়ে ৪২ গুন বড়। সিডনিতে সিটি কর্পোরেশন ১৪ টি। সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দাবানলে ২২ জনের মৃত্যু, ১৫০০ বাড়িঘর ভস্মীভূত হবার কারন বনভূমি এবং খামার এলাকাগুলোয় বসতি কম। বাংলাদেশের চুড়িহাট্টার একগলিতে কত মানুষের মানুষের মৃত্যু হলো আগুনে পুড়ে! অথবা কেরানিগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায়? সব মৃত্যুই করুন-বেদনার। তুলনামূলক আলোচনা দিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আদিবাসী এলাকার উট গুলি করে মারার ঘটনার অনেক নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু এরা অস্ট্রেলিয়ার আরও অনেক বাস্তবতা জানেননা। দাবানলে পথঘাট বন্ধ হয়ে গেলে আগুনে পুড়ে মরে পরিবেশ দূষনের আশংকায় খামারের অনেক গরু-ভেড়া সহ নানা পোষা প্রানীও আগেভাগে গর্ত করে মাটিচাপাও দেয়া হয়।
বাংলাদেশে বন্যা-ঘূর্নিঝড় এসব মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা-ঘূর্নিঝড় অস্ট্রেলিয়াতেও হয়। বাড়তি ভয়াল দূর্যোগটির নাম দাবানল। বাংলাদেশে বনাঞ্চল কম। অস্ট্রেলিয়ায় বনাঞ্চল বেশি। বনাঞ্চল বেশি থাকার বিপদও যে আছে দাবানল এর প্রমান। আগে অস্ট্রেলিয়ায় যে পরিমান বৃষ্টি হতো এখন অনেক কম বৃষ্টি হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত দীর্ঘ খরা এবার অস্ট্রেলিয়াকে দাবানলের ভিতর নিয়ে গেছে। বৃষ্টিবিহীন বনে শুকিয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে হয় থাকা পাতায় পাতায় ঘর্ষনে আগুল লাগে। আবার আগুন লাগানোর ঘটনাও ঘটে। সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে নিছক মজা করা অথবা বাধা অগ্রাহ্য করার নিয়তে বনে যারা আগুন লাগায় তাদের মধ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক থেকে শুরু করে বয়সে পৌঢ় লোকজনও আছে। এদের নাম দেয়া হয় আরসেন। আরসেনকে গ্রেফতার করে শাস্তিও দেয়া হয়। যেহেতু প্রতি বছরই বনে আগুন লাগে তাই বুশ ফায়ার নিয়ন্ত্রনের জন্যে আলাদা শক্তিশালী প্রশাসন আছে অস্ট্রেলিয়ায়। যেমন হাঙ্গর অনুসরনেরও আছে আলাদা প্রশাসন। সমুদ্র থেকে হাঙ্গর যখন তীরের দিকে আসে তখন আকাশ থেকে হেলিকপ্টার-ড্রোন থেকে এসব হাঙ্গরকে অনুসরন করলে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া যায়।
বাংলাদেশে যেমন বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে নানা সতর্ক ব্যবস্থা নেয়া হয় অস্ট্রেলিয়ায় তেমন দাবানলের আশংকায় টোলাল ফায়ার ব্যান সহ নেয়া হয় নানা সতর্কতা। অস্ট্রেলিয়ানরা বারবিকিউ প্রিয় জাতি। বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে মাংস পুড়িয়ে খেতে ভালোবাসে। সঙ্গে হিমশীতল চিল্ড বিয়ারে গলা ভেজানো। কিন্তু ওই বারবিকিউর আগুন বাতাসের তাড়ায় উড়ে গিয়ে বলে আগুন লাগতে পারে এই আশংকায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় টোটাল ফায়ার ব্যান। এমন ঝুঁকিপূর্ন বন্যা-দাবানল এলাকার লোকজনকে স্থানান্তরিত করে নেয়া হয় নিরাপদ এলাকায় মিলনায়তন অথবা ইনডোর স্টেডিয়ামে। সেখানে তারা খাবার-পানীয়-চিকিৎসা-বিনোদন সবকিছুই দেয়া হয় স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে।
অস্ট্রেলিয়ার এসব দুর্যোগে মানুষ যেভাবে এগিয়ে আসে তা যে কারো মনকে নাড়া দেবে। এসব দুর্যোগে স্বেচ্ছাসেবক হতে লাইন পড়ে যায়। এই স্বেচ্ছাসেবকদের আবার অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে আবেদন করতে হয়। একবার কুইন্সল্যান্ডের বন্যায় স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করতে যেতে রেজিস্ট্রেশন করে যোগাযোগ করলে ধন্যবাদ জানিয়ে বলা হয়, তাদের হাতে এখন প্রয়োজনের চেয়ে স্বেচ্ছাসেবক আছেন। আরও স্বেচ্ছাসেবকের প্রয়োজন হলে অবশ্যই যোগাযোগ করা হবে। যদিও সেবার সুযোগটি আর হয়নি। দাবানল পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিন্তু সেভাবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবক নেবার সুযোগ কম। আগুন জ্বলা এলাকার পথঘাট বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ভেতরে যারা কাজ করেন তারা মূলত প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ফায়ার ফাইটার। এবার অস্ট্রেলিয়ার দাবানল মোকাবেলায় আমেরিকা এবং কানাডা থেকেও ফায়ার ফাইটাররা এসেছেন। বাংলাদেশের সবকিছুতে মন্ত্রীরা ব্রিফিং করেন। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় মূলত এসব ব্রিফিং করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কারন দুর্যোগ তারাই সামাল দেন।
এখন সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে শপিংমল সহ নানা জায়গায় গেলে দেখা যাবে ত্রান কার্যক্রম। দাবানলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন, কৃষক-খামারি তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে সারাদেশ। সরকার থেকে এরমাঝে ক্ষতিগ্রস্তদের কয়েকটি শিরোনামে পচাত্তর হাজার ডলার করে সাহায্য দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক-বীমা কোম্পানি সহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নানান প্যাকেজ সহায়তা প্রস্তাব সহ এগিয়ে এসেছে। আর সারাদেশের মানুষের বাড়িয়ে হাততো আছেই। দাবানল পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টার মুখে চীনের করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব শংকাকে কেন্দ্র করে নতুন সংকটে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া। কারন চীনের অর্থনীতির সঙ্গে নানাভাবে জড়িত এই দেশ। অস্ট্রেলিয়া কিন্তু এসব সংকট সহজে পাড়ি দেবে। কারন এদেশের মানুষ পরিশ্রমী। এরা মিথ্যা কথা বলেনা এবং দুর্নীতি করেনা।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা