কুড়িগ্রামে গেলেই চোখে পড়ে শিশুর কোলে শিশু’র দৃশ্য
লাইলী ইয়াসমীন
বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলোর নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও বাল্য বিবাহ থেমে নেই কুড়িগ্রামে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হলেও বাল্য বিবাহ চলছেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিয়েগুলো রেজিষ্ট্রি ছাড়া।
কখনও কখনও রেজিষ্টারের মূল ভলিউমে না উঠায় বিয়ে প্রমাণ করাও যাচ্ছে না। তবে বাল্য বয়সী মেয়েরা ঘর সংসার করছে। তারা মা-ও হচ্ছে। ফলে বাল্যবয়সী মায়ের সংখ্যাও অনেক।
ঘোগাদহ ইউনিয়নের মরাটারী গ্রামে মতিয়ারের কন্যা মুক্তা এবছর ঘোগাদহ উচ্চ বিদ্যালয় হতে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে তার বিয়ে হয়। একই গ্রামের মমিনের কন্যা মোসলেমা আগামী বছরের দাখিল পরীক্ষার্থী। কিছুদিন আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম সদরের ঘোগাদহ ইউনিয়ের সর্বত্র এমন চিত্র খুব স্বাভাবিক।
সম্প্রতি ঘোগাদহ ইউনিয়নে সরকারি যত্ম প্রকল্পের সদ্য তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের একটি বৈঠকে গিয়ে দেখা যায় সেখানে উপস্থিত বেশির ভাগ প্রসূতি মা বাল্য বিয়ের শিকার এবং তারা শিশু বয়সেই সন্তানের মা হয়েছেন।
এই বিয়েগুলোর অধিকাংশই রেজিস্ট্রি ছাড়াই হয়। কখনও কখনও রেজিষ্ট্রি হলেও মূল ভলিউমে না লিখে খসড়া ভলিউমে লেখা হয়। তাদের কারো ন্যাশনাল আইডি কার্ড নেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিয়ে হয় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের ব্রহ্মত্তর গ্রামের হাজেরা বেগমের। বিয়ের দুই বছরের মাথায় যমজ সন্তানের মা হাজেরা। শিশু বয়সের হাজেরা এখন দুই শিশু সন্তানের মা। এখন হাজেরার বয়স ১৬ বছর। আর হাজেরার যমজ দুই কন্যা সন্তানের বয়স ২২ মাস।
১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় একই গ্রামের লিপি খাতুনের। বিয়ের এক বছর পরই সন্তানের মা হন লিপি। ১৫ বছর বয়সের লিপির কোলে এখন ২২ মাসের শিশু সন্তান।
এমন শিশু বয়সেই মা হয়েছে ওই গ্রামের আঁখি, শাহীনা আক্তার সহ অনেক শিশু কিশোরী যাদের বয়স ১৮’র নিচে। যদিও প্রশাসন বলছে অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন এবং বয়স যাচাই করে বিয়ে রেজিস্টারের বাধ্যবাধকতা থাকায় জেলায় বাল্য বিয়ের হার অনেকাংশে কমে গিয়েছে। তবে ঘোগাদহ ইউনিয়নের সমাজকর্মীদের তথ্য মতে এখনও ওই ইউনিয়নে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ শিশু বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে।
ঘোগাদহ ইউনিয়নে বাল্য বিয়ে নিয়ে কাজ করে এনজিও কর্মী আতিকুর রহমান। তিনি জানান, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্রতা ও অসচেতনতার কারণে এই ইউনিয়নে এখনও বাল্য বিয়ে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব বিয়ে হচ্ছে খুব গোপনে। অনলাইনে বয়স যাচাই করা ও বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার কথা থাকলেও কিভাবে বাল্য বিয়ে হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আতিকুর বলেন, ‘ বাল্য বিয়ে দিতে আসা কাজিদের কাছে নিবন্ধন বইয়ের বিকল্প বই থাকে। তারা বয়স ছাড়া বর ও কনের যাবতীয় তথ্য সেখানে লিপিবদ্ধ করেন। পরে বর ও কনের নির্ধারিত বয়স পূর্ণ হলে তারা এসব তথ্য মূল ভলিয়মে নিবন্ধন করেন। আর বিয়ে বৈধতা দেওয়ার জন্য কাজিরাই শরিয়া আইন অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে সম্পন্ন করান।’
স্থানীয় ব্যক্তি রাইয়ান কবির জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করেই গোপনে বিয়ে হয়। যখন প্রকাশ হয় তখন রীতিমতো তারা সংসার করছে। তখন আর বলার কিছু থাকে না।
স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ‘ছায়া’- দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় বাল্য বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিরসনে কাজ করছে । ”ছায়া”র সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন,‘ ঘোগাদহ ইউনিয়নে শিশুবিয়ের হার প্রায় ৫০ ভাগ। আমরা প্রথম দিকে শিশু বিয়ে প্রতিরোধে কাজ করে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছি। এখন শিশু বিয়ের কুফল নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছি। এটা অনেকটা কাজে দিচ্ছে। ফলে বিগত কয়েক বছরে বাল্য বিয়ের হার ৭০ ভাগ থেকে কমে এখন ৫০ ভাগে এসেছে। বাল্য বিয়ের শিকার এসব মেয়ে অল্প বয়সেই মা হচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভুগছে।’
গত ২৪ নভেম্বর রাতে শাহানাজ পারভীন নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে জানিয়ে খোরশেদ বলেন,‘ গভীর রাতে গোপনে এসব বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরের দিন আমরা খবর পাই। ফলে আর তেমন কিছু করার থাকে না।
ঘোগাদহ ইউনিয়নে বাল্য বিয়ের প্রবণতার কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানা যায়, দারিদ্রতা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মেয়ের বয়সের সাথে যৌতুকের আপেক্ষিক হার বাল্য বিয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়াও শিশু বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক মানসম্মানের ভয়ে কন্যা শিশুদের আগেই বিয়ে দিয়ে দেন।
জমিলা বেগম নামে এক অভিভাবক জানান, তার দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে তিনি বছর খানিক আগে বিয়ে দিয়েছেন। তার মেয়ের কোলে এখন দেড় মাস বয়সের সন্তান। কম বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুকও কম দেওয়া লাগে।’
ঘোগাদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ওই ইউনিয়নে বেশির ভাগ বাল্য বিয়ে হচ্ছে অশিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত দরিদ্র পরিবারগুলোতে। সাবালক হলে বেশি যৌতুক দিতে হয়, এজন্য নাবালক অবস্থায় তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে অপরিণত বয়সে সন্তানের মা হচ্ছে এসব শিশুরা। বেসরকারী সংস্থা আরডিআরএস এর বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গালস প্রজেক্টের অধীনে জেলার বিভিন্ন স্থানে “বাল্য বিবাহ মুক্ত” এলাকা ঘোষণা দেয়ার সাইনবোর্ড দেয়া থাকলেও সাইনবোর্ডের পাশের বাড়িতেও বাল্য বিবাহ হচ্ছে। এব্যাপারে আরডিআরএস এর প্রজেক্ট অফিসার রেজোয়ান সাতিল জানান, আমাদের প্রজেক্ট কাজ শুরু করেছে প্রায় দুই বছর আগে।তখন বাল্য বিবাহের হার অনেক বেশি ছিল। এখন তা ৪০ ভাগে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে পুরোপুরি বন্ধ হতে অনেক সময় লাগবে। ঘোগাদহ ইউয়িনে বাল্য বিয়ের প্রবণতা সম্পর্কে জানতে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলমের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, ‘ বাল্য বিয়ে এবং অপরিণত বয়সে মা হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি সহ প্রশাসনিক সব প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে গোপনে এবং এলাকার বাইরে গিয়ে বাল্য বিয়ের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে আমরা দূর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করার কাজ করছি এবং সে অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রস্তাবনা প্রেরণ করছি। তবে বাল্য বিয়ের হার দিন দিন কমছে।’
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভিন জানান, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে আমরা প্রতিটি উপজেলায় সর্বাতত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। পৃথক পৃথক কমিটি করা হয়েছে তদারকির জন্য। তবুুও দূর্গম ও বেশি দরিদ্রতম এলাকাগুলোতে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। বিয়ে রেজিষ্ট্রি না করে গোপনে বিয়ে হয়ে গেলে পরবর্তীতে করার তেমন কিছু থাকে না। তবুও সচেতনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
# সিনিয়র সাংবাদিক ও সালমা সোবহান ফেলো, কুড়িগ্রাম।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা