প্রচণ্ড জ্বরে নিস্তেজ, প্রতিবেশীদের ডেকে সাড়া না পাওয়া, অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য ফোন, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ আর বিভিন্ন হটলাইনে ফোন করে ব্যর্থ হওয়ার পর মারা গেলেন বগুড়ার শিবগঞ্জের সেই ব্যক্তি (৪৫), যাঁর পাশে সারা রাত জেগে ছিলেন অসহায় স্ত্রী-সন্তান।
গাজীপুরে জ্বর, সর্দি ও কাশিতে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি শিবগঞ্জে আসেন। ওই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত—এমন আতঙ্কে কেউ তাঁর পরিবারের আকুতিতে সাড়া দেয়নি।
গত শুক্রবার রাতে ওই ব্যক্তির অবস্থার অবনতি হয়। গতকাল শনিবার দুপুরে একজন চিকিৎসক গিয়ে তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাঁর নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছিল। এ ঘটনার পর এলাকার ১০টি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই ব্যক্তি গাজীপুরের কাশিমপুরে ব্যবসা করতেন। তাঁর স্ত্রী বগুড়ার একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করার সূত্রে শিবগঞ্জে থাকেন। তাঁদের বাড়ি কাহালু উপজেলায়। তাঁদের আট বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে।
গত ২৪ মার্চ জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন তিনি। এ অবস্থায় গত মঙ্গলবার রাতে তিনি শিবগঞ্জে স্ত্রীর বাসায় চলে আসেন। শুক্রবার সন্ধ্যার পর বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ কিনে সেবন করেন। এরপর রাতে অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে নিতে পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চান স্ত্রী। কিন্তু করোনা সন্দেহে কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এরপর রাতভর তিনি বিভিন্ন স্থানে ফোন করেও সাহায্য পাননি।
ওই ব্যক্তির স্ত্রী বলেন, ‘স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রথমে আমি পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু করোনা আক্রান্ত সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেননি। এরপর আমি অ্যাম্বুল্যান্সের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করি জেলা সদর ও উপজেলা হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কাছে। কিন্তু সারা রাত ধরে চেষ্টা করার পরও কোথাও থেকে কোনো সাড়া পাইনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি রাতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইনে ফোন দিয়েও কাউকে পাইনি। রাতে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের হটলাইনে ফোন করেছি, কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেনি।’
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবীর জানান, ‘যেহেতু নিহত ব্যক্তি মারা যাওয়ার আগে শরীরে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ ছিল সে কারণে করোনা সন্দেহে ওই বাড়িসহ পার্শ্ববর্তী ১৫টি বাড়িকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে, নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় জ্বরে আক্রান্ত আল আমিন (২২) নামের এক যুবক মারা গেছেন। তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে সন্দেহ করছেন এলাকাবাসী। পরিবারের অভিযোগ, করোনা সন্দেহে হাসপাতালে ওই যুবকের চিকিৎসা না করায় তার মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার রাত ১০টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মৃত আল আমিন অলংকার দীঘি গ্রামের মকলেছুর রহমানের ছেলে।
এদিকে আল আমিনের মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে আসলে গ্রামের কোন লোকজন করোনা ভাইরাস সন্দেহে তার মৃতদেহের কাছে যাচ্ছে না।
আল আমিনের বাবা মকলেছুর রহমান জানান, আল আমিন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। শুক্রবার রাতে আল আমিন শরীরে প্রচণ্ড জ্বর আর কাশি নিয়ে ঢাকা থেকে নওগাঁতে যান। এরপর শনিবার সকালে বাড়িতে আসার সময় তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহে স্থানীয় মেম্বার ও গ্রামের কতিপয় লোকজন তাকে গ্রামে উঠতে দেননি।
বাধ্য হয়ে সকালেই এলাকার ভেটি স্ট্যান্ড থেকে চিকিৎসার জন্য পাশের বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কোনো চিকিৎসা না করেই ফিরিয়ে দেন সেখানকার চিকিৎসকরা। এরপর তাকে ভেটি কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়। সেখানে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না করেই বারান্দায় আল আমিনকে মূর্মূষু অবস্থায় রাখা হয়।
পরে স্থানীয়রা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানালে পরে তার সহযোগিতায় চিকিৎসার জন্য প্রথমে রাণীনগর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। সেখানে করোনা ভাইরাস সন্দেহে চিকিৎসকরা দেখেই নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঠান।
তিনি বলেন, নওগাঁ হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সেখানেও আল আমিনকে ভালোভাবে না দেখে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠান তারা। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেও কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কিছু ওষুধ ও ইনজেকশন লিখে দিয়ে চলে যান চিকিৎসকরা। সেগুলো দিয়েও আমার ছেলের শরীরের জ্বর কোন ভাবেই কমে না। এরপর কোনো চিকিৎসক আমার ছেলের আশেপাশে আর আসেনি। অবশেষে আমার ছেলে রাতে মারা যায়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বাচ্চু বলেন, ছেলেটা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এমন খবর পাওয়ার পর তার পরিবারকে বলেছি চিকিৎসকের প্রতিবেদন নিয়ে গ্রামে আসতে। যদি চিকিৎসকরা বলেন, আল আমিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নয় তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আর যদি সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে চিকিৎসা করান। গ্রামে আসার দরকার নেই। গ্রামবাসী ও আশেপাশের মানুষের কথা ভেবেই আল আমিনকে গ্রামে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কেএইচএম ইফতেখারুল আলম খাঁন বলেন, আল আমিনের শরীরে জ্বর ছিলো। তাকে যখন আমরা হাসপাতালে পাই তখন সে অবচেতন অবস্থায় ছিলো। যেহেতু তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো সেহেতু আমরা তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নওগাঁ সদর আধুনিক হাসপাতালে পাঠায়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, মৃত আল আমিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার কথা বলবো। তবে সে হয়তো বা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়নি। এছাড়াও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে আল আমিনের দাফন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা