অনলাইন ডেস্ক
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আজম জে চৌধুরীর ইস্ট-কোস্ট গ্রুপ (ওমেরা এলপিজি), সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ (বেক্সিমকো এলপিজি), আহমেদ আকবর সোবহানের বসুন্ধরা গ্রুপ (বসুন্ধরা এলপিজি), আব্দুর রাজ্জাকের জেএমআই গ্রুপ (জেএমআই এলপিজি), হাসান মাহমুদ রাজার ইউনাইটেড গ্রুপ (ইউনাইটেড এলপিজি), মোস্তফা কামালের মেঘনা গ্রুপসহ (ফ্রেশ এলপিজি) এ খাতের ব্যবসায়ীদের হাতের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিইআরসি। আর সরকারও নিজেকে সপে দিয়ে বসে রয়েছে। তারা যা খুশি তাই করছেন, যেনো কারো কিছু করার নেই, কেউ কিছু করারও সাহস দেখাচ্ছে না। বিইআরসি কিছুটা উদ্যোগী হলেও পিছু হটেছে বাধ্য হয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে যে সার্পোট পাওয়ার কথা তা কখনই পাচ্ছে না।
২০২১ সালের ১২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো এলপি গ্যাসের দর ঘোষণা করে বিইআরসি। বিইআরসির আদেশে বলা হয়েছিল সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে প্রতি মাসের ভিত্তিমূল্য বিবেচিত হবে। সৌদির দর উঠা-নামা করলে এলপিজির মূল্য উঠা-নামা করবে। আমদানিকারকের অন্যান্য কমিশন ও খরচ অপরিবর্তিত থাকবে।
১২ এপ্রিল দর ঘোষণার দিনেই আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা হয়। তারা দাবি করে দর বেশি হওয়া উচিত ছিল। ঘোষিত দরে তাদের ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এরপর থেকে বিইআরসির সঙ্গে টানাপোড়েন শুরু হয় লোয়াবের। তারা প্রতিমাসের দর ঘোষণাও বর্জন করে। নিজেদের ইচ্ছামতো দরে বেচাকেনা করতে থাকে। অন্যদিকে বিভিন্নভাবে বিইআরসির ওপর চাপ তৈরি করে,এলপিজি আমদানি বন্ধ করার হুমকি দেন লোয়াব সভাপতি আজম জে চৌধুরী। এক পর্যায়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ অনেকটা ব্যবসায়ীদের সুরেই কথা বলতে থাকেন।
দর ঘোষণার দুই মাস পর (১৫ জুন ২০২১) সাংবাদিক সম্মেলন করে এলপিজি আমদানিকারকদের সংগঠন লোয়াব। সংগঠনটির সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তাড়াহুড়া করে একটি মূল্যহার নির্ধারণ করেছে। দাম নির্ধারণে জন্য একটি প্রতিষ্ঠানের যে ধরনের যোগ্যতা, দক্ষতা থাকা দরকার তা তাদের নেই। পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম নির্ধারণে তাদের কোনো বিধিমালা নেই। তাহলে তারা কীভাবে দাম নির্ধারণ করে। যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে তা একপেশে। তারা এই শিল্পকে ধ্বংস করতে চায়। তাদের এ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এলপিজির সংকট তৈরি হচ্ছে। তারা যে দাম নির্ধারণ করেছে সেটি বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
লোয়াবের চাপে বিইআরসি অনেকটা বাধ্য হয়েই (৫ মাসের মাথায় ১৩ সেপ্টেম্বর) ফের শুনানি নিয়ে কমিশন বাড়িয়ে দেয়। এপ্রিলে ঘোষিত দরে এলপিজির আমদানিকারক, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার জন্য ১২ কেজির সিলিন্ডারে মোট ৩৫৯ দশমিক ৪০ টাকা কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরেরবার সেই চার্জ বাড়িযে ৪৪১ টাকা করা হয়। অর্থাৎ ১২ কেজি সিলিন্ডারে কমিশন বাড়ানো হয়েছে ৮১ দশমিক ৬ টাকা। ডিলার এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশন বাড়িয়ে যথাক্রমে ৩৪ ও ৩৮ টাকা করা হয়েছে।
যেভাবে প্রতিশ্রুতি থেকে সরেছে লোয়াব
দর যখন নিম্নগামী তখন মাইনাস ওয়ান (আগের মাসের) ফর্মুলায় তাদের কোন আপত্তি ছিল না। আমদানিকৃত গ্যাস সিস্টেমে আসতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লেগে যায় সে কারণে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতেই মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ আগের মাসের দর অনুযায়ী পরের মাসে গ্যাসের দর নির্ধারিত হতে থাকল। কয়েক মাস পরে যখন বাজারে ঊর্ধ্বগতি শুরু হলো, তখনেই বাগড়া দিয়ে বসে এলপিজি আমদানিকারকরা। তারা বলা শুরু করে, মাইনাস ওয়ান ফর্মুলায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, বর্তমান মাসের দর অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। বিইআরসি দর ঘোষণার আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। বিইআরসিও তাদের কথায় বাধ্য হয়ে মাইনাস ওয়ান বাতিল করে দেয়।
লোয়াবের আরেকটি বড় দাবি ছিল, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতার কমিশন বৃদ্ধি। তবে মার্কেট ঘুরে এর সত্যতা মেলেনি। প্রতিযোগিতার বাজারে খুচরা বিক্রেতারা ২০ টাকাতেই সন্তুষ্ট। ব্যতিক্রম ছাড়া তারা এভাবেই বিক্রিতে অভ্যস্থ। তারা যে দামে পাচ্ছে তার সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ টাকা যোগ করে বিক্রি করার নজির রয়েছে। ওই কমিশনও ডিলার না হয় মালিকের পকেটে যাচ্ছে।
লোয়াব দাবি করে আসছে তাদের বিদেশ থেকে আনতে জাহাজ ভাড়া যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। জবাবে বিইআরসি তাদের কনার্শিয়াল ইনভয়েস দাখিল করতে বললেও দাখিল থেকে অনেকেই বিরত থেকেছে। যারা ছোট ছোট জাহাজে এলপিজি আনছে তাদের কয়েকটি ইনভয়েস দাখিল করে। লোয়াব বরাবরই দারি করে আসছে টনপ্রতি তাদের পরিবহন খরচ পড়ছে ১১০ ডলার থেকে ১৩০ ডলার পর্যন্ত। লোয়াব যখন এই দাবি করেছে সেই সময়ে মোংলা বন্দর থেকে টিকে গ্রুপের একটি ইনভয়েস সংগ্রহ করে তাতে টনপ্রতি মাত্র ৬৫ ডলার জাহাজ ভাড়া দেখা গেছে। বিষয়টি বিইআরসি জানলেও চাপের মুখে পরিবহন খরচ ৯৫ ডলার করে দেয়। যদিও তাদের এপ্রিলের আদেশে বলা হয়েছিল জাহাজ ভাড়া কমিয়ে আনতে হবে। দরকার হলে কয়েকজন মিলে গ্রুপ করে বড় জাহাজে আমদানি করে পশ্চিমবঙ্গের মতো জাহাজ ভাড়া কমাতে হবে।
ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, ২৮টি কোম্পানির মধ্যে গণশুনানিতে মাত্র ১২টি কোম্পানি ইনভয়েস দাখিল করেছে। সেই দরের গড় করে দর চূড়ান্ত করার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। আমরা গণশুনানিতে দেখিয়ে দিয়েছি, পশ্চিমবঙ্গে ২০ ডলারে আমদানি করছে, একই দূরত্বে বাংলাদেশে ১২০ ডলার হতে পারে না। আমরা বলেছিলাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কমার্শিয়াল ইনভয়েস সংগ্রহ করে যাচাই করতে। বিইআরসি তা না করে ৯৫ ডলার দর চূড়ান্ত করে অন্যায় করেছে।
লোয়াব নতুন করে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কথা বলে আবার কমিশন বাড়ানোর দাবি তুলেছে । ইতিমধ্যে ১১টি কোম্পানি পৃথকভাবে কমিশন বাড়ানোর আবেদন জমা দিয়েছে। অবাক করা তথ্য হচ্ছে ইতিমধ্যেই তারা বাজারে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চলতি মাসে (আগস্টে) ১২ কেজি সিলিন্ডারের খুচরা মূল্য ১২১৯ টাকা করা হলেও তারা ১২৮০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করছে। বিষ্ময়কর হচ্ছে কোম্পানিগুলো প্রকাশ্য বলছে বিইআরসি নির্ধারিত দরে বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাদের সেই বক্তব্যের পর লাইসেন্স বাতিল হওয়ার কথা, কিন্তু বিইআরসি হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে।
পরিবহন খরচ বৃদ্ধির জন্য যে আবেদন করেছে এবারও কমার্শিয়াল ইনভয়েস জমা দেয়নি তারা। অভ্যন্তরী্ণ মার্কেটে ডিজেলের ব্যবহার সংক্রান্ত কোন ডকুমেন্ট দাখিল করেনি। লোয়াব দাবি করেছে দেশের অভ্যন্তরে সিলিন্ডারবাহী ট্রাকগুলো ডিজেলে চলে। ডিজেলের দাম বেড়েছে তাই এলপি গ্যাসের পরিবহন খরচ বাড়াতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে বেশিরভাগ ট্রাক অটোগ্যাসে চলে, রয়েছে বিশাল বিশাল সিলিন্ডার। সমুদ্রে জাহাজের খরচ বেড়েছে এ কথা সত্য কিন্তু কি পরিমাণে বেড়েছে তার উপযুক্ত প্রমাণ হচ্ছে কমার্শিয়াল ইনভয়েস। সেখানে এলপি গ্যাসের দর, জাহাজ ভাড়া অন্যান্য খরচ লিখে কাস্টমসে দাখিল করতে হয়। সেই কমার্শিয়াল ইনভয়েস দাখিল করতে কার্পণ্য কেনো তা বোধগম্য নয়। এনবিআর থেকে তথ্য সংগ্রহে বিইআরসিরও অনীহা, প্রকৃত সত্য থেকে যাচ্ছে আড়ালে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বার্তা২৪.কম-কে বলেন, দর মনিটরিং করার জন্য ভোক্তা অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে বলা হয়েছে। বিইআরসি একার পক্ষে মনিটরিং করা সম্ভব না। বেশি দরে বিক্রি করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত দরে অটোগ্যাস বিক্রি করায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জরিমানা করতে শুরু করেছে। এলপিজির মূল্য নিয়ন্ত্রণে সেই উদ্যোগকে থামিয়ে দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব)। অভিযান বন্ধে বিইআরসির হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দেয় লোয়াব। তবে কমিশন পাল্টা এক চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছে, এ ধরনের অভিযান তারা বন্ধ করবেন না। উল্টো তাদের ঘোষিত দরে এলপিজি বিক্রি না করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, এম মাইনাস ওয়ান ফর্মুলার বিরোধীতা করেছিলাম আমরা। ব্যবসায়ীদের আগ্রহেই এম মাইনাস ওয়ান করা হয়। প্রশাসনের সকল পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয়, অন্যায়ভাবে যেসব কাজ হচ্ছে সব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিরোধী। বিইআরসি তার আইনের ৪৬ ধারার আওতায়, অবহেলার কারণে নিজেই আইনের কাঠগড়ায়। যে কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান অবজ্ঞা করার সুযোগ পাচ্ছে। এসব কার্যক্রম দেশের জ্বালানি সংকটের চেয়েও ভয়াবহ। এই পরিস্থিতিতে শাসন বিভাগের ওপর বিচার বিভাগের হস্তপেক্ষের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে এলপিজি ব্যবহৃত হয়েছে ৪৪ হাজার ৯৭৪ মেট্রিক টন। কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে ১২ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ টন ও ২০৪১ সালে চাহিদা হবে ৬০ লাখ টন। দেশে ব্যবহৃত এলপিজির সাড়ে ৯৮ ভাগ আমদানি নির্ভর। সরকারি (বাংলাদেশ এলপি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড) কোম্পানির মার্কেট শেয়ার মাত্র দেড় শতাংশের মতো। সরকার এখন পর্যন্ত ৫৬টি কোম্পানি অনুমোদন দিয়েছে। এরমধ্যে ২৮টির মতো মার্কেটে রয়েছে, বেশকিছু কোম্পানি প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা