আমাদের একজন মনু আপা ছিলেন
লাবণ্য লিপি
অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন মাস্টার্সে পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি কয়েকটি দৈনিকে প্রদায়ক হিসেবে কাজ করি। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার নেশায় ব্যুঁদ হয়ে দু’হাতে ফিচার লিখে যাচ্ছি। নিয়মিত লিখছিলাম ‘দৈনিক জনকন্ঠ’ পত্রিকায়। একদিন লেখা জমা দিতে অফিসে গেছি। রুমা আপার পাতায় লিখতাম। আপা বললেন, আগামী শুক্রবারে ফ্রি আছ? জানতে চাইলাম কেন আপা? বললেন, আমরা একটা সংগঠন করি। মহিলা পরিষদ। সেখানে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান আছে। পারলে চলে এসো! বলে ঠিকানা লেখা একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিলেন।
আমি ছাত্রী মানুষ। ছুটির দিনে কী আর এমন কাজ। চলে গেলাম সেই অনুষ্ঠানে। মনে আছে সে অনুষ্ঠানে গন্যমান্য সব নারী সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। আমি সবাইকে চিনতাম না। চেনার কথাও না। আমি নিতান্ত একজন ছাত্রী। লেখাপড়ার পাশাপাশি পত্র- পত্রিকায় কেবল লিখতে শুরু করেছি। যখন যার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয় তখন তাকে চিনি। এতেও চেনাজানার সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছিল না। তার কারন আমি ছিলাম একটু মুখচোরা স্বভাবের। আগ বাড়িয়ে কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়া বা কথা বলার আগ্রহ আমার ছিল না। বরং আমি অপেক্ষা করতাম সামনে যিনি আছেন তিনি কথা বললে আমি তার কথার পিঠে কথা বলব। মাঝে মাঝে সেটুকুও খুব দক্ষতার সঙ্গে করে উঠতে পারতাম না।
কোন কথার পিঠে কোন কথাটা বলব সেটা ভাবতেও আমার খানিকটা সময় চলে যেত। তার ওপর আবার দেখতেও আমি তেমন সুশ্রী নই। কাজেই ‘পয়লা দর্শনদারি’র যোগ্যই যে নয়, তার আবার গুণ বিচার করবে কে? আর গুনও যে খুব ছিল সে সময়, সে দাবীও তো জোর গলায় করতে পারিনি। কেননা নিজের আত্মবিশ্বাসটা ঠিক তখনও শক্ত পোক্ত হয়ে ওঠেনি। আর তাই সে অনুষ্ঠানে আমি এক কোনায় চুপচাপ বসে ছিলাম। তখনই শুরু হলো অনুষ্ঠান। শুরুতেই পরিচয় পর্বের পালা। সঞ্চালক ঘোষণা করলেন, আজ পরিচয় পর্বটা হবে একটু অন্যভাবে। আপনার পাশে যিনি বসে আছেন আপনি বলবেন তার সম্পর্কে। আর তিনি বলবেন আপনার সম্পর্কে। নিজেদের মধ্যে কথা বলার জন্য আপনাদের পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হলো।
ব্যাপারটা আমার কাছে মজার মনে হলেও আমি তখনই চিন্তি হয়ে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম, আমার পাশে যিনি আছেন আমি তো তাকে চিনি না। তাহলে তাকে আমি কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেব! এর সহজ সমাধান তার সঙ্গে কথা বলে তার সম্পর্কে জেনে নেওয়া। কিন্তু আমার সে সাহস তখন ছিল না। কারন আমার পাশে যিনি বসেছেন তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র একজন। আর নিঃসন্দেহে তিনি গন্যমান্য কেউ। আমি মফন্বল থেকে ঢাকায় পড়তে আসা নিতান্ত এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে। ওনাদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ তো আমার হয়নি। আমার এই ঘাটতিটুকু নিশ্চয়ই ওনাদের হাসির খোরাক হবে ভেবে আমি চুপচাপ বসে থাকি। অথচ আমার পাশেরজন কিন্তু নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করলেন। আমি কোথায় পড়ি, কী করি, কোথায় থাকি, আমার পছন্দ- অপছন্দ ইত্যাদি নানা বিষয়ে। অথচ আমি এমনই বোকা যে কেবল তার প্রশ্নের জবাবই দিয়ে যাচ্ছিলাম। তার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাচ্ছিলাম না।
আমার এই না পারাটাও বোধকরি তিনি বুঝতে পারলেন। তিনি নিজেই নিজের নাম- পরিচয় আমাকে দিলেন। তারপর শুরু হলো কথা মতো পরিচয় পর্ব। কয়েকজন বলার পর এলো আমাদের পালা। উনি দাঁড়িয়ে সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম- ধাম বলার পর উনি আমার জন্য শুভকামনা করলেন, আশা করছি আজকের এই তরুনি মেয়েটি জীবনে অনেক বড় হবে। নিজের মেধায়- দক্ষতায় নিজের জায়গা করে নেবে সাংবাদিকতার জগতে! তার কথা শুনে আমি নিজের মধ্যে আরও কুঁকড়ে যেতে থাকি। ফলে তার সম্পর্কে যা বলব বলে ঠিক করেছিলাম সেটাও ভুলে গেলাম। তাই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আমি শুধু তার নামটাই বলতে পেরেছিলাম। উনি সেটাও ক্ষমা সুন্দরভাবেই নিয়েছিলেন। বললেন, ও ছোট মানুষ। বেচারা কথা বলতেই ভয় পাচ্ছে। তারপর নিজেই নিজের সম্পর্কে বললেন। আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।
এতক্ষণ যার কথা বললাম তিনি দিল মনোয়ারা মনু। আমাদের সকলের মনু আপা। সেই দিন থেকেই আপা আমার ভরসার জায়গাটা নিয়ে নিলেন। তারপর থেকে যখনই কোনও দরকার হয়েছে, কোনও বিষয়ে জানতে চাই, কারো সম্পর্কে জানতে চাই, নিঃসঙ্কোচে আপাকে ফোন করেছি। এটা- ওটা জানতে চেয়েছি। যখনই বিশেষ কোনও লেখা দরকার হয়েছে, যা চাইলে আর কেউ দিতে পারবেন না বলে মনে হয়েছে, তখনই মনু আপার কথা মনে পড়েছে। সুফিয়া কামালের মুত্যু বা জন্মবার্ষিকী, অথবা অন্য কোনও মহিয়সী নারীকে নিয়ে লেখা চাই, মনু আপা লেখা দিন! আপা কখনও ‘না’ বলেননি। এত জানতেন।
আমরা যাদের নিয়ে পাঁচশ শব্দ লিখতে হিমশিম খেয়ে যাই, আপা তাদের নিয়ে কী অনায়াসেই না হাজার হাজার শব্দ লিখে দিতেন। আমি পড়ে যেতাম বিপদে। পাতার জায়গা অনুযায়ী যত বড় লেখা চাই, আপা হয়তো লিখেছেন তার দ্বিগুণ। আমি পড়ে যেতাম মুশকিলে। আপার লেখা কাটব কীভাবে! এ কথা আপাকে বলতেই আপা বলতেন, আরে তোমার যতটুকু দরকার মনে হয় ততটুকু রেখে বাকিটা কেটে ফেলো। তবে দেখো, দরকারী কথাগুলো যেন থাকে। এ কথা কখনও বলেননি, আমাকে আবার দেখিয়ে নিও। বরং ছাপা হওয়ার পর আপা ফোন করে জানিয়েছেন, ভালো সম্পাদনা করেছ।
কতটা প্রশ্রয় দিলে, ভালবাসলে জুনিয়রের প্রশংসা করা যায়? ক’জনই বা তা করতে পারেন? আমার জন্য তার শুভকামনা কতটা ফলেছে আমি তা জানি না। তবে এটুকু জানি, সেদিনের তার ঐটুকু শুভেচ্ছা আমাকে করে তুলেছিল আত্মবিশ্বাসী। আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমাকে আমার কাজ দিয়ে সাংবাদিকতার জগতে টিকে থাকতে হবে। আছি এখনও। মনু আপাও ছিলেন এবং থাকবেনও। আমার মতো তার গুণমুগ্ধ আরও অনেকের মনে তিনি চিরদিনই থাকবেন!
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা