বই আলোচনা
তাসকিনা ইয়াসমিন : ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বইটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি দেখেছেন তাদের স্মৃতিচারণমূলক বই। বইটিতে উঠে এসেছে ৭১ এর ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা।
সেই সময় বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তানের) হিন্দু জনগেষ্ঠীর মানুষ যে ভয়ঙ্কর নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়েছে তাই লেখা হয়েছে বইয়ের প্রতিটি লাইনে প্রত্যেক লাইনে লাইনে আছে শহীদের রক্তগাঁথা, হৃদয় বিদারক সব দৃশ্যের বর্ণনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের হিন্দু-মুসলিম উভয় জনগোষ্ঠী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট সব ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে তখন। সব ঘটনাগুলো বইটিতে বিভিন্ন ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় উঠে এসেছে।
বইয়ের পৃষ্ঠা ২ এ মো. ইমান উদ্দিন মোল্লার বক্তব্য, ‘তাদের বাড়িতে হিন্দুরা ও শহর থেকে অনেকেই এসে দুই-তিন মাস ছিলেন। তাদের জমিতে অনেক ধান হওয়ায় আশ্রিতদের খাওয়া নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি।’
সেই সময় এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান বাহন ছিল নৌকা এবং গরুর গাড়ি। এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বিভিন্নজনের বক্তব্যে। পৃষ্ঠা ৪ এ রাধারমণ পাল এর বক্তব্য ‘জিনিসপত্র আর বুড়ি মাকে গাড়িতে (মহিষের) করে বাকি সবাই হেঁটে যাই। ইশেলমারী মাখন গোঁসাইয়ের বাড়িতে এক রাত্রি কাটাই। এখান থেকে শিকারপুর বর্ডার পার হয়ে ভারত পৌঁছাই।’
মুক্তিযুদ্ধে খুঁজে খুঁজে হিন্দুদের বাড়ি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি পোড়াত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তাদের সহযোগিতা করত রাজাকাররা। পৃষ্ঠা ৮ এ কৃষক সুবোধ চন্দ্র বলছেন, ‘সাহা গ্রামে এক বাড়িতে রাজাকাররা আগুন দেয়।’
সম্পাদক তার বইয়ে তখনকার চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে পৃষ্ঠা ৮ এ লিখছেন ‘ গ্রামে সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, আমাশয় ও কলেরা হতাে। যুদ্ধ করতে গিয়ে আহত, ডাকাতি ও লুট করতে গিয়ে আহত কিংবা ডাকাত ও লুটেরার হাতে নানাভাবে লোকজন আহত হতো। পল্লী চিকিৎসকরাই এসব রোগের চিকিৎসা করতেন।
পুরো বইটিতে অনেকেই নিজেদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বলেছেন। একাত্তরের শরনার্থী জীবনের পরে তারা নিজের সংগ্রাম করে এখন সমাজ এবং পারিবারিক জীবনে সফল। কারো কারো আক্ষেপ আছে তারা নিজেদের সম্পদ হারিয়েছেন। এখনও শরীরে আঘাতের চিন্থ বয়ে বেড়াচ্ছেন কিন্তু রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা পাননি। এখনও তাদের দুবেলা দুমুঠো ভাতের লড়াই চলছেই।
সে সময় বহু মানুষ নিজের জীবনের বিনিময়ে বাঁচিয়েছেন তার পরিবার এবং আশপাশের মানুষকে। এর মধ্যে যেমন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন তেমনি ছিলেন সাধারণ মানুষ।
সেই সময়ের গর্ভবতী নারীদের প্রসব প্রসঙ্গে পৃষ্ঠা ৯ এ ফরিদপুরের মধুখালি থানার ডুমাইন গ্রামের যতীন্দ্রনাথ মণ্ডল বলছেন, ‘প্রসবের সময় সাধারণত সাহায্য করতেন দাইমারা।’
তখনকার সময়ে বিবাহ ও সামাজিক অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে সম্পাদক লিখছেন, ‘বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধ চলাকালেও কিছু বিয়েশাদি হয়েছিল। তবে অনুষ্ঠান কম হয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, বিয়েশাদি সম্ভব ছিল না। কোথাও কােথাও জোর করে বিয়ের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ স্থানে মুসলমানদের বিয়ে হয়েছে, হিন্দুদের তেমন বিয়ের ঘটনা পাওয়া যায়নি।’
পৃষ্ঠা ১০ এ সম্পাদক লিখছেন, ‘হিন্দু যারা মারা গেছে তাদেরকেও নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে সুযোগ পাওয়া গেছে সেখানে সৎকার করা হয়েছে।… ভারতে যাওয়ার পথে যেসব শরণার্থী মারা গেছেন, তাঁরাও ভেসেছেন নদীতে অথবা পরিণত হয়েছেন শিয়াল, কুকুর, কাক, চিল, শকুনের খাদ্যে।’
‘ঘোষবাগ গ্রামের অমল চন্দ্র সাহা বলেন, কবিরহাটে ক্যাম্পে মানুষ হত্যা করে মাটিতে গলা পর্যন্ত গর্ত করে পুঁতে রাখা হয়।’ অঞ্চলভিত্তিক চিত্রে, ঢাকার ভূতের গলির বাসিন্দা সুশীল সূত্রধর তার বর্ণনায় বলেন, ‘তারা বলেন, দেখেন ওখানে অনেক মানুষকে পুড়িয়ে ফেলেছে। সেখানে দেখলাম, একটা মানুষ বসে আছে। কিন্তু পুরোটা শরীর পুড়ে ছাই।’
পৃষ্ঠা ৩৭ এ সত্যব্রত সাহার বক্তব্য ‘ বাবার কথায় জানতে পারলাম। ছেলেটা (যে কিছুক্ষণ আগে বাসা থেকে গেল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে কাজ করে। সবাইকে কাতারে গুলি করে মেরেছে, ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে পাক আর্মি গুলি করে মেরেছে ২৫ মার্চ।’
ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করা হয় বহু নিরপরাধ মানুষকে। তাদের অনেকের অপরাধ ছিল তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কেউ আবার কেন মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে তাই মিলেছে এই মর্মান্তিক শাস্তি। পৃষ্ঠা ৫৭ তে একজনের বর্ণনায়, ‘সে সময় ধলঘাটের আরো অনেক হিন্দু-মুসলমানকে ধরে পটিয়া ক্যাম্পে নিয়ে যায় রাজাকাররা। অমূল্য সেনের কাকা হিরন্ময় দেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি। হিন্দু পাড়ার এমন কোনো বাড়ি ছিল না যেটা রক্ষা পেয়েছিল তাদের অগ্নিসংযোগ থেকে।’
পৃষ্ঠা ১৮ তে নারী নির্যাতনের চিত্রে সাঁওতার শ্রীমতী শেফালী রানী জানান, এক রাজাকার আর্মি নিয়ে এসে তাঁদের গ্রামে বাড়ি বাড়ি লুট করতে থাকে। এ দিনই মুকুলের (নাম পরিবর্তন) বাড়িতে লুট করে যাওয়ার সময় পালিয়ে থাকা তাঁর বউকে দেখে ফেলে ও তাঁর ওপর অত্যাচার করে। এ ঘটনার পরে বউটা অনেকদিন বাইরে বের হতো না। .. আমরা যারা জানতাম তাঁরা বিষয়টা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করি।’
বইয়ে বহু মুক্তিযুদ্ধে শহীদের কথা জানা যায়। পৃষ্ঠা ১৪৯ এ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে সরদার ফজলুল করিম বলছেন, ‘আহা! কী মর্মান্তিক মৃত্যু বাংলাদেশের ভাষার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ৮৫ বছর বয়সে।’ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র উপর নির্যাতন প্রসঙ্গে রমণীশীল বলেন, ‘বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগানো, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখেছি।’ ১৫৪ পৃষ্ঠায় রমণী শীল বলেন, ‘সারাদিন চোখের সামনে শত শত বাঙালি হত্যার দৃশ্য দেখা এবং সেই কালরাত্রিটি অতিবাহিত করা যতটা না অসহনীয় ছিল, তার চাইতেও কঠিন ও দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়াল যখন আমাকে উপস্থিত জল্লাদদের দাড়ি কাটার নির্দেশ দেওয়া হলো।’
১৭২ পৃষ্ঠায় শরনার্থী শিবিরের বর্ণনা দিয়ে একজন বলছেন, তখন নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। ভাবতাম, কোথায় ছিলাম আর এখন কীভাবে আছি। যেখানে আপনার দুজন লোক থাকতে হয়, সেখানে পাঁচজন-সাতজন লোক জড়াজড়ি করে থাকতে হয়। নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ হয়ে যাচ্ছে।’ মুক্তিযোদ্ধা নিধুরাম দত্ত সম্পর্কে অনিন্দিতা মজুমদার বলেন, ‘নিধু ফিরল তার তিন দিন পর কাঁধে বন্দুক নিয়ে। তাকে দেখে গ্রামে ছেলে মেয়েদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। সবচেয়ে কম বয়সী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে গেছে।’
১১৬ পৃষ্ঠা কার্জন হলের মালি বড়মোহন বলেন, তখন হলের সামনে লাশের লাইন ছিল, ভেতরের লাশগুলো সব আনা হয়।ওই লাইনে আমাকেও শোয়ানো হয়। আমার স্ত্রীর পাশেই আমাকে শোয়ানো হয়। তখন আমি বলি, ‘আমার স্ত্রীর বডিটা দেখি কেমন?’ আমার স্ত্রীর বুকে পেছন দিয়ে মেরেছে। ওটা দেখে আমি আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’
জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার মেয়ে মেঘনা গুহ ঠাকুরতা বলেন, ‘বাবার ঘাড়ে একটা গুলি লেগেছে আর কোমরে একটা গুলি লেগেছে। সেই রাত্রে আমরা কোথাও তার চিকিৎসা করাতে নিয়ে যেতে পারিনি। ২৭ মার্চের সকালে যখন কারফিউ ভাঙে তখন রাস্তার কিছু লোক এসে আমাদের জিজ্ঞেস করে, রাস্তায় অনেক গোলাগুলির আওয়াজ পেলাম, আপনাদের কোন সাহায্য লাগবে? তখন আমরা বাবার কথা জানাই। তারাই তখন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা তারপরে হাসপাতালে যাই। তখনো উনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন, বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ উনি গুরুতর আহত হয়েছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী কোয়ার্টারে অবস্থান করা রাজকুমারী বলেন, ‘যখন ছেলে এবং পুরুষদের নিয়ে গেছে, তখন আমরা অসহায়ের মতো সবাই এক জায়গায় বসে পড়ছি। … একেক জন লোকের পিছে দুইজন করে সেনাবাহিনীর লোক। লাত্থি মারে আর লাশ টোকাইতে কয়। টোকাইতে টোকাইতে মাঠে একেবারে ভিড় করছে অনেক লাশ।’
১৩৩ পৃষ্ঠায় একজন বর্ণনাকারী বলছেন, ‘ওরা আমারে দেখে গোসল করাইয়ে দিল, হাত ব্যান্ডেজ করে দিল। সাদা লুঙ্গি দিল, পাঞ্জাবি দিল, জিন্নাহ মার্কা টুপি দিল আমারে, তখন আমি ফুল মুসলমান। আমি কলমাও (কালেমা)জানি।’
সেসময় যেমন ছিল অমানবিক মানুষ।মানবিক মানুষও ছিল। পৃষ্ঠা ৮৭ তে একজন বর্ণনাকারি বলছেন, ‘বলার দিয়ারের জাফর হাজী হিন্দুদের অভয় দিতেন এবং পাক বাহিনীর অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতেন। তিনি রাজাকারের হাত থেকে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর ভাতিহজ জামাইয়ের প্রাণরক্ষা করতে পারেননি।’
অনেক মুক্তিযুদ্ধের শহীদের নাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সরকারিভাবে নথিভুক্ত হয়নি বইটি পড়ে এমনটি বোঝা যায়। যেমনভাবে আসেনি রোকেয়া হলের সেই মুসলিম ছাত্রী যাকে বাবা বাড়িতে নিরাপদে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এলে বুড়িগঙ্গায় নৌকায় ওঠার মুহুর্তে ধর্ষণের শিকার হয়। এখানে ঘটনা বর্ণনাকারী বলেন, সেই মেয়েটির কারণে আমরা অনেক মানুষ তখন পাকিস্তানিদের হাত থেকে বেঁচে যায়। অথচ, মুক্তিযুদ্ধের অবদান হিসেবে বলার সময় রোকেয়া হলের সেই নাম না জানা ছাত্রীর অবদানের মতো সাধারণ মানুষদের অবদান অনেকেই স্বীকার করেনা!
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা