মো. আলী আশরাফ খান
যেভাবে হয় লবণ চাষ
লবণ নিত্যদিনের খাদ্য তালিকার অন্যতম উপাদান। খাদ্য তালিকার বাইরেও ডাইং, কাপড় তৈরি, চামড়া শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লবণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিন্তু কী করে হয় লবণ চাষ, তা কিন্তু অনেকেই জানেন না। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ইসলামপুর ইউনিয়নের অনেকাংশ এলাকা জুড়ে হয় লবণ চাষ।
ইসলামপুর ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটি ছোট নদী। ঈদগাহ মাঠের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে স্থানীয়রা এ নদীকে ঈদগাহ নদী বলে থাকেন। এ নদী ঘেষে বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে হয় লবণ চাষ।
নদীর লবণাক্ত পানি দিয়েই উৎপাদিত হয় লবণ। সমতল ভূমিকে চারপাশে মাটির ছোট আইল (মাটি দিয়ে উঁচু করে বেড়ার মত) দিয়ে ছোট প্লট আকৃতির জায়গা বানানো হয়। এবার সেই প্লটগুলো রোদে ভালভাবে শুকিয়ে কাঠের রোলার ঘুরিয়ে সমতল করা হয়। এরপর নদী থেকে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে সাগরের লোনা পানি এনে ছোট ছোট ওই প্লট ভর্তি করা হয়।
এভাবে পানি সংগ্রহ করার পর ৪ থেকে ৫ দিন রোদে রাখা হয়। কড়া রোদে পানি বাষ্পীভূত হতে থাকে। এই লবণাক্ত পানি একটা প্লট থেকে আরেকটা প্লটে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে ছয় /সাতবার স্থানান্তরিত করার পর সর্বশেষ যে প্লটে ঘনীভূত পানি আনা হয় সেখানে আগে থেকেই মোটা পলিথিন সীট বিছানো থাকে।
বাষ্পীভূত ঘন লবণাক্ত পানি রৌদ্রের তাপে শুকিয়ে লবণের মোটা স্তর পড়ে থাকে পলিথিনের ওপর। এবার জমে শক্ত হয়ে যাওয়া সেই লবণ বেলচা দিয়ে মাঠে একত্রিত করে রাখা হয়। সবশেষে এই লবণ গুদামে নিয়ে সংরক্ষণ করা হয় অথবা রিফাইনারিতে নিয়ে মেশিনের মাধ্যমে লবণ রিফাইন করে বস্তাভর্তি করা হয়। মাঠে লবণ তৈরির সময় লবণের সাথে যাতে কাদা মাটি না লাগে এজন্য জমিতে পলিথিনের সীট বিছিয়ে দেয়া হয়।
প্রতি বস্তায় সাধারণত ৮০ কেজি করে লবণ থাকে। লবণ মাঠ থেকে সেই লবণ বিভিন্ন রিফাইনারিতে নিয়ে গিয়ে সেন্টিফিউগাল মেশিনের সাহায্য জোরে পানি প্রবাহিত করে সেই পানি দ্বারা লবণ ধৌত করে কাদা ময়লা আলাদা করে ফেলা হয়।
বর্তমানে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান সাদা রিফাইন করা সেই লবণ নিয়ে নিজেদের মেশিনে রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে আরো ধবধবে সাদা ঐ ঝরঝরে করে তাতে নির্দিষ্ট পরিমাণে আয়োডিন মিশ্রিত করে ভোজ্য লবণ প্রস্তুত করে। এরপর সুদৃশ্য পলিব্যাগে মোড়কজাত করে তা বাজারে সরবরাহ করে ।
লবণ চাষ মূলত আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। একটু ঝড় বৃষ্টি হলেই লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং লবণ চাষীদের অনেক আর্থিক ক্ষতি হয়। শীতের কুয়াশাও লবণের জন্য ক্ষতিকর। তাই এর চাষ খুবই ঝঁকিপূর্ণ। লবণ চাষের ভরা মৌসুম হচ্ছে ফাল্গুন-চৈত্র মাস।
এছাড়া আরও চার মাসও লবণ উৎপাদন হয় ভালো। মোটামুটি বছরের পাঁচ/ছয় মাস লবণ চাষ করা হয়। বছরের বাকি ছয় মাস একই জায়গায় চাষ হয় লোনা পানির চিংড়ি। কড়া রোদ থাকলে চৈত্র মাসে এক একরে ২৫০ মণ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়।
সারাদেশের লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মেটানো হয়ে থাকে। কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর ইউনিয়ন ছাড়াও কুতুবখালী, মহেশখালী, ইসলামাবাদ, ফুকখালী, বাড়বুআলী, চপুলদন্ডীসহ বেশ কিছু জায়গায় লবণ চাষ হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরা জেলার উপকূলবর্তী জমিতে লবণ চাষ হয়।
যেসব জায়গায় লবণ চাষ করা হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না। ইসলামপুর লবণ শিল্প এলাকা থেকে নৌকা ও ট্রাকে করে বিভিন্ন জেলায় লবণ সরবরাহ করা হয়। লবণ চাষকে কেন্দ্র করে ইসলামপুরে রয়েছে ৪০টি রিফাইনারি কারখানা।
সারা দেশে লবণ রিফাইনারির সংখ্যা বর্তমানে ২৬৩ টি। একটি রিফাইনারি চালু রাখতে হলে সপ্তাহে কমপক্ষে ৭০ টন লবণ প্রয়োজন হয়। লবণ রিফাইনারির প্রতিটি ফ্যাক্টরিতে ৩০-৪০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
আরও পড়ুন : যুক্তরাজ্যের নেভীতে সুযোগ পেল বাংলাদেশের মেহেদী
জানা যায়, পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজার জেলায় লবণ চাষ শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ব্যবসা বিকাশ লাভ করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার এদেশে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উপকূলীয় জমি পরিষ্কার করে সাগরের পানি সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে এক ব্যক্তি লবণ চাষ শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার গোমাতলী মৌজাতে এক ব্যক্তি ১২০ একর জমি দীর্ঘ মেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেন। সে থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) তথ্যমতে, কক্সবাজার জেলায় ৬৩ হাজার ৫৩২ একর লবণের মাঠ রয়েছে। আর লবণ চাষি রয়েছেন ৪৩ হাজার ৫০০ জন।
# লেখক, মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত), বিসিক।
ফেসবুক : চলবে …
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা