এম.উমর ফারুক
সাংবাদিকতা বিষয়ে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করিনি আমি। আর রাজধানীতে কোন পত্রিকার স্টাফ রির্পোটার হিসেবেও সাংবাদিকতা শুরু করিনি। শুরুটা করেছি মফস্বল থেকে। উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী প্রতিনিধি হিসেবে। যার লেখা খবর পত্রিকার পাতায় পড়ে সাংবাকিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছি, আবার সাংবাদিকতাকে জীবনে পেশা হিসেবে নিয়েছি। তিনি হলেন চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের একটি স্মরণীয় নাম। শুধু সাংবাদিক নন তিনি নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।
একজন উপজেলা প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিক্ষণে বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আর সমাধান খুঁজে নিতে হয়েছে মোনাজাত উদ্দিনের বইগুলো থেকে। গ্রামে থেকেও যে চ্যালেঞ্জিং সাংবাদিকতা করা যায় তার উদাহরণ একমাত্র তিনি। গ্রামে গঞ্জে, পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে এই তথ্যানুসন্ধানী সংবাদকর্মী তাঁর সাংবাদিক জীবনে নানা মাত্রিকতার রিপোর্ট করেছেন। পাশাপাশি লিখেছেন জীবনের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ নানা ঘটনা। চারণ সাংবাদিক মোঃ মোনাজাত উদ্দিন-এর জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাছড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে।
পিতা মোঃ আলিমউদ্দিন আহমদ, মাতা মতি জানন্নেছা। কর্মজীবনে রংপুর পৌরসভায় উচ্চমান করণিক, রংপুর এসপি অফিসের প্রধান করণিক ছিলেন মোঃ আলিমউদ্দিন। চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের হিসাব রক্ষক হিসেবে। রংপুর শহরের ধাপ এলাকায় ছিল তাঁর আবাস। আলিমউদ্দিন ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। অপ্রকাশিত ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও রচনা করেছিলেন। তাঁর লেখালেখির র্বনাঢ্য জীবন আমাকে আরো কাছে টানে। কত দুর্দান্ত সাহসী তিনি।
রংপুরের প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘ দৈনিক রংপুর’ এর প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের মার্চে স্বাধীন চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘ দৈনিক রংপুর’। ‘দৈনিক রংপুর’ ছিল মিনি সাইজের পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ পয়সা। মোনাজাত উদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক-প্রকাশক। পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য আর্থিক সহযোগিতা করতেন একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী। বাহ্যিকভাবে সেই ব্যবসায়ী সৎ মনে হলেও,প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন অসৎ ব্যবসায়ী। যে কারণে তাঁর সঙ্গে মোনাজাত উদ্দিনের সম্পর্কে ইতি ঘটে।
অবধারিতভাবেই এই পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঢাকায়‘ দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ । মোনাজাত উদ্দিনকে তাই জীবিকার তাগিদে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকুরি নিতে হয় বাধ্য হয়ে। কিন্তু লেখালেখির সাথে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। ১৯৭৬ সালে দৈনিক সংবাদে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন পত্রিকাটির সাথে। বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’ এ কাজ করার পরে ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ।
ছাত্র জীবনেই তাঁর লেখা লেখির সুচনা। সাংবাদিক হিসেবে প্রথম তিনি কর্মজীবন শুরু করেন ‘বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘ দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেন স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে । পরে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায় কাজ করে ১৯৬৬ সালে ‘ দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে কাজে যোগদান করেন। দৈনিক আজাদ বন্ধের পর ১৯৭৬ সালে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করার সুযোগ পান। তারপর থেকে একটানা প্রায় বিশ বছর সেখানেই কাজ করেছেন । ‘সংবাদ’ই ছিল তাঁর ঠিকানা।
বিশ বছর একটানা ‘সংবাদ’-এ কাজ করার পর তিনি দৈনিক জনকন্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করেন ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল। ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীরে যান গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘ শেরেবাংলা’ নামক ফেরিতেই তিনি দুর্ঘটনার মুখে পতিত হন। ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। স্থানীয় নৌকার মাঝিরা তাঁর দেহ তাৎক্ষনিকভাবে উদ্ধার করতে পারলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। তিনি ছিলেন জনগণের সাংবাদিক।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা এবং পেশায় সফল এক নাম মোনাজাত উদ্দীন, দেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে চিরবরনীয় হয়ে থাকবেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি মোনাজাতউদ্দিন প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের কুসংস্কার, অন্ধতা দূর করতে তিনি তরুণদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। কখনো তাদের নিয়ে নাটক করিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলতে। তিনি নিজেও ছিলেন একজন গীতিকার ও নাট্যকার। রংপুর বেতারের নিয়মিত কাজ করতেন। তাঁর একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
যদিও চারুশিল্পে তাঁর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু নিজের অধ্যাবসায়ের ফলে তিনি অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন । মোনাজাত উদ্দিন সাংবাদিকতার পাশাপাশি অনেক বই লিখেছেন। যে বইগুলো সংগ্রহ করে আমি পড়তাম। তাঁর বইগুলোই আমার সাংবাদিতার বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিত। তার মৃত্যুর আগে ৯ টি ও পরে ২ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
‘পথ থেকে পথে’, ‘সংবাদ নেপথ্য’, ‘কানসোনার মুখ’, ‘পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ’, ‘নিজস্ব রিপোর্ট’, ‘ ছোট ছোট গল্প’, ‘অনুসন্ধানী রিপোর্ট’: ‘গ্রামীণ পর্যায়’, ‘চিলমারীর এক যুগ’, ‘শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী’, ‘লক্ষীটারী’, ‘কাগজের মানুষেরা’। যেহেতু আমি চিলমারী থেকে সাংবাদিকতা করতাম, সেহেতু চিলমারীর একযুগ বইটি ছিল আমার পথ প্রর্দশক। এক্ষেত্রে মোনাজাত উদ্দিনকে আমার সাংবাদিকতার গুরু হিসেবে শিকার করি।
তিনি আপাদমস্তক একজন কাগজের মানুষ। সাংবাদিকতায় তাঁর সাহসিকতা আর চ্যালেঞ্জ নেওয়ার হিম্মত আমার সিদ্ধান্ত নিতে সহজ করেছে। উপজেলার সাংবাদিতা ছেড়ে রাজধানীতে চলে আসি সাংবাদিতা জন্য জন্য। একেবারেই অপরিচিত ইট পাথরের ঢাকা শহরে দৈনিক যুগান্তরে লেখালেখি শুরু করি। প্রতিদিন হতাশ হয়ে ভাড়া ম্যাচে ফিরে যাই। মনস্থির করি আমাকে দিয়ে হবে না এ শহরের সাংবাদিকতা। তখন মোনাজাত উদ্দিনের ‘নিজস্ব রিপোর্ট’ বইটি পড়তে থাকি। এক পর্যায়ে মনের শক্তি বেড়ে যায়।মনস্থির করি, আমি পারবো। আমাকে পারতেই হবে।
#লেখক, কবি, রিপোর্টার, সংস্কৃতি কর্মী।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা