All-focus
ড. ইকবাল হুসাইন
বছর ঘুরে বিশাল সমারোহে আবার শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা। দেশ-বিদেশের লাখো মুসল্লির পদভারে মুখরিত টঙ্গীর তুরাগতীর। তাবলিগ জামাতের বার্ষিক এই সম্মেলন মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম জমায়েত। সরকার এবং সাধারণ মানুষের আন্তরিক সহযোগিতায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সাফল্যের সাথে আয়োজিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। নিষ্ঠার সাথে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা এবং ইমান ও আমল ও আকিদার চর্চায় তাবলিগ জামাতের সুনাম রয়েছে। নানা উস্কানি এবং প্রলোভন সত্বেও তাবলিগ জামাতের মুরুব্বিরা প্রচলিত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হননি। স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বজায় রেখে তারা নিজেদেরকে কেবল দীনের দাওয়াতে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তবে তাবলিগ জামাতের মধ্যে সম্প্রতি যে বিভেদ ও সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা তাদের ঐতিহ্যবিরোধী। ভারতের মাওলানা সাদ কান্দালভির কিছু বক্তব্যকে কেন্দ্র করে বিবদমান দু’পক্ষের সহিংস ঘটনায় ইতোমধ্যে প্রাণহানী হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে সরকারের মধ্যস্থতায় মাওলানা সাদ এবং মাওলানা জোবায়েরের অনুসারীরা পৃথকভাবে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করছেন।
বাংলাপিডিয়ায’র তথ্য মতে, ১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াস (রহঃ) ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায় তাবলিগি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। তাঁর সময় থেকেই এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ভারতের দেওবন্দকেন্দ্রিক আলেমরা মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে আরো সচেতন করে তোলার লক্ষ্য নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রমের বিস্তার ঘটান। বাংলাদেশে প্রথম তাবলীগের জামাত নিয়ে আসেন তাবলিগ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মোহাম্মদ ইলিয়াসের (রহঃ) ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ (রহঃ)। ঢাকায় প্রথম তাবলিগি-সম্মেলন (ইজতেমা) আয়োজিত হয় ১৯৫৪ সালে লালবাগ শাহি মসজিদে। ১৯৬৫ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে একটি বিদেশি জামাত আসে। দেশি-বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণে এটিই ছিল প্রথম বিশ্ব ইজতেমা। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরের বছর (১৯৬৬) ইজতেমা হয় টঙ্গীর মনসুর জুট মিলের কাছে। ১৯৬৭ সাল থেকে ইজতেমা শুরু হয় টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে। স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিশ্ব ইজতেমার জন্য ১৬০ একর জমি নির্ধারণ করে দেন। বর্তমানে প্রায় ১৬৫ একর জমির উপর বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি বছর তুরাগের পশ্চিম পাড়ে আরো প্রায় তিন একর জমির উপর সামিয়ানা টানানো হয়েছে।
গত ৫০ বছরে ঢাকা এবং এর আশেপাশের এলাকার যেমন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি বিশ্ব ইজতেমারও কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। টঙ্গীর তুরাগতীরকে একসময় ঢাকার বাইরে বিবেচনা করা হলেও নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় এখন এটি ঢাকা-গাজীপুরের কেন্দ্রস্থল এবং ঢাকার অন্যতম ‘প্রবেশদ্বার’। ঢাকা-গাজীপুরে যেমন প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বিশ্ব ইজতেমায়ও মুসল্লির সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত কয়েক বছর যাবৎ বিশ্ব ইজতেমা আয়োজন করা হচ্ছে দু’টি পর্বে। প্রথম কয়েক বছর জেলাভিত্তিক হলেও গত বছর থেকে বিবদমান দু’টি গ্রুপের জন্য পৃথক দু’টি পর্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। দুই পর্বে বৃহস্পতিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত চার দিন করে মোট আট দিন টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুরের পুরো অঞ্চলটিতে ভয়াবহ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। কেবল বিশ্ব ইজতেমা নয়, জোড় ইজতেমার সময়ও প্রায় একই অবস্থা। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড, আব্দুল্লাহপুর হয়ে উত্তরবঙ্গ, সিলেট, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জসহ দেশের একটি বৃহদাংশের সাথে ঢাকার যোগাযোগ এবং স্থানীয় যাতায়াত একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আব্দুল্লাহপুর এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ। সামগ্রিকভাবে ঢাকার এই অন্যতম প্রবেশদ্বারটি অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বর্তমান বাস্তবতায় টঙ্গীর তুরাগতীরে বিশ্ব ইজতেমার মত বিশাল আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাবলিগ জামাতের মুরুব্বি এবং সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবারই এ বিষয়ে বিকল্প ভাবা উচিত।
আমি মনে করি, বিশ্ব ইজতেমার ময়দান স্থানান্তরিত হওয়াই সবথেকে ভালো বিকল্প। এক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার কথা ভাবা যেতে পারে। পরিকল্পিতভাবে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলে এখানে মুসল্লিদের যাতায়াতে খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আরেকটি বিকল্প হতে পারে গাজীপুরের মৌচাক। এখানে প্রতি বছর স্কাউটের অনেক বড় বড় কর্মসূচি আয়োজিত হয়। তাবলিগ জামাত এবং স্কাউট কেউই সারা বছর তাদের নিজ নিজ ময়দান/স্থাপনার পুরোটি ব্যবহার করে না। দু’টি সংগঠনের (তাবলিগ জামাত ও স্কাউট) মধ্যে সমন্বয় করে সহজেই একই স্থানে উভয়ের কাযক্রম পরিচালনা করা সম্ভব। বিপুল জনসংখ্যার স্বল্পায়তনের এই দেশে এ ধরনের উদ্যোগ অনেক বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। উল্লিখিত দু’টি বিকল্পের কোনোটি সম্ভব না হলে আশুলিয়া, গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর কিংবা শ্রীপুরের কোনো একটি সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করা যেতে পারে। নবনির্বাচিত স্থানে ৩/৪ তলাবিশিষ্ট পাকা শেড নির্মাণ করা উচিত। সাথে বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন এবং রান্নার সুবিধা। তুরাগতীরে প্রতি বছর অস্থাযী সামিয়ানা-প্যান্ডেল তৈরি করা হয়। বৈরি আবহাওয়ায় এখানে মুসল্লিদেরকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দেশি-বিদেশি, সরকারি-বেসরকারি অনুদানে খুব সহজেই বিশ্ব ইজতেমার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ পাকা এবং স্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব।
বিশ্ব ইজতেমার স্থান পরিবর্তন করা সম্ভব হলে মহাখালী বাস টার্মিনালকে তুরাগতীরের বর্তমান ময়দানে স্থানান্তর করা উচিত। ঢাকার পেটের মধ্যে অবস্থিত এই টার্মিনালটি এখন যানজটসহ নানাবিধ সমস্যা তৈরি করছে। একটি প্রশস্ত টার্মিনালের জন্য পর্যাপ্ত জায়গাও এখানে নেই। এটি বর্তমান ইজতেমা ময়দানে স্থানান্তরিত হলে উত্তর-ঢাকার যানজট হ্রাসসহ সিটি কর্পোরেশনকে আরো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সুপরিসর জায়গায় বাস টার্মিনাল হলে ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গ এবং সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক সহজ এবং গতিশীল হবে। বলা যেতে পারে একটি সিদ্ধান্ত অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, নগর পরিকল্পনায় আনতে পারে ইতিবাচক পরিবর্তন। সরকার এবং তাবলিগ জামাতের নীতিনির্ধকরা কি বিষয়টি ভেবে দেখবেন?
ড. ইকবাল হুসাইন, সহযোগী অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।
ihusain1979@gmail.com, ১০ জানুয়ারি ২০২০।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা