ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে দায়ী করার মানসিকতা পরিহার করতে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
সোমবার ( ২৫ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর -১০ ডিসেম্বর) পালন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সহ-সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রী য় কার্যালয়ের সুফিয়া কামাল ভবন মিলনায়তন, ঢাকাতে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন পরিচালক, লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি এন্ড লবি অ্যাড. মাকছুদা আখতার। এবছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের প্রতিপাদ্য প্রজন্ম সমতা: ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান- আলোকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ “ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ-আসুন এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে কেন্দ্র, সারাদেশের জেলা ও তৃণমূল শাখাসমূহে একযোগে ১৫ দিনব্যাপী বহুমূখি কর্মসূচি পালনের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি চলমান সহিংসতা প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে পালন করা হবে। আশা করি এই কর্মসূচি নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা, প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্র ও সরকারের দায়বদ্ধতা, মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়, নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সুপারিশমালা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষকালব্যাপী পনেরো দিনের কর্মসূচি এবং ১৪ টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংরক্ষিত তথ্যের ভিত্তিতে নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি নির্যাতনের একটি সমীক্ষা উপস্থাপন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ২০ টি সুপারিশ তুলে ধরেন।
লিখিত বক্তব্য শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন বর্তমানে নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি নির্যাতনের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে, সমগ্র বিশ্বের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। ফলে নারী ও কন্যার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনও আমরা দেখতে পাই। আইন শৃংখলা বাহিনী, বিচার প্রক্রিয়ার সাথে যারা যুক্ত আছেন তাদের জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাব রয়েছে। অন্যদিকে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা অন্যতম কারণ হিসেবে ভূমিকা রাখছে।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ বলেন ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড এর প্রস্তাবনাসহ সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহারে জন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুপারিশ আইনকমিশনে জমা দেয়। প্রেরিত সুপারিশমালার উপর গবেষণা করে আইন কমিশন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিলেও পরবর্তীতে কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি।
তিনি নারী পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করতে নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচি গণমাধ্যমে যথাযথভাবে তুলে ধরতে তিনি সাংবাদিকদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি বলেন বেইজিং ঘোষণার অন্যতম হচ্ছে সিডও সনদ বাস্তবায়ন করা। বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার অন্যতম উদ্বেগের ক্ষেত্র নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমের বাস্তব চিত্র গণমাদ্যম তুলে ধরছে যা সংগঠনের ধারাবাহিক আন্দোলনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১) (গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের প্রসঙ্গে সংগঠনের সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম বলেন এই সংরক্ষণ প্রত্যাহার সকলের দাবি। এটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি ও ঢাকা মহানগর শাখার সহ-সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু ধর, লিগ্যালএইড সম্পাদক আইরিন পারভীন বিভিন্ন সংগঠনের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. দীপ্তি সিকদার এবং অ্যাড. রাম লাল রাহা সহ বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠক ও কর্মীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন : আপনি কি যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা বা বক্তৃতা দানে আগ্রহী?
সুপারিশগুলো হচ্ছে :
১. নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার সুনিদির্ষ্ট কর্মসূচি গ্রহন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার নারীকে দায়ী করার মানসিকতা পরিহার করতে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে।
২. ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রকে ধর্ষণের শিকার নারীর পাশে দাড়াতে হবে এবং তার মানসিক শক্তি বৃদ্ধি, চিকিৎসাসহ ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে হবে।
৩. নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়, প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে।
৪. অপরাধীকে চিহ্নিত করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কট এবং আইনের আওতায় আনতে হবে; অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৫. অভিযোগকারী যেন অনলাইনে তার অভিযোগ নিবন্ধন করতে পারেন, সেজন্য ওয়েবসাইট চালু করতে হবে।
৬. মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
৭. নিরাপদ অভিবাসনসহ দেশে ও বিদেশে নারী শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮. মানবপাচার রোধ ও মানবপাচারের শিকার নারীদের দেশে ফিরিয়ে আনা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে।
৯. অভিবাসী নারী বিদেশে চাকুরীকালে নিরাপত্তাসহ সকল স্বার্থ সংরক্ষনে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের বাংলাদেশ দূতাবাস এর কার্যকরী ভূমিকা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে।
১০. নারী ও কন্যার প্রতি উত্ত্যক্তকরণ, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণসহ সকল প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন।। নারী ও কন্যার প্রতি ধর্ষণ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
১১. নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বন্ধে অধিকতর কার্যকর, দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে পৃথক পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় করতে হবে।
১২. মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোন বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষনিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে।
১৩. উত্ত্যক্তকরণ ও যৌন নিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১৪. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায় এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্তে প্রোটোকল বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৫. ধর্ষণের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। প্রচলিত আইন পরিবর্তন করে ধর্ষণকারীকেই ধর্ষণ করে নাই এ বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে মর্মে বিধান আইনে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মামলার সাক্ষীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
১৬. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১২ এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
১৭. পারিবারিক সংহিসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন, ২০১০-র বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।
১৮. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৯. জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
২০. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে। (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়সমূহ।
ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা