অনলাইন ডেস্ক
তখন ৮ বছর বয়সী শিশুটির নাম ছিল শশী। সে তামিলনাড়ুর এক বাসস্টেশনে ভিক্ষা করতো। রাতে ঘুমাতো কাছের এক সিনেমাহলের বাইরে। তো সেদিনও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে শিশু শশী। শোয়ার আগে সে মেঝেটা ঝাড় দিচ্ছিলো। এসময় এতিমখানার কর্মীদের নজরে পড়ে শশী। তারা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে। আর এই ঘটনাই পথশিশু শশী কিংবা আজকের স্যাশ সিম্পসনের জীবন বদলে দেয়। আর স্যাশের ভাষায় এটিই হচ্ছে ভাগ্য।
তিনি বলেন-‘আসলে সময় হচ্ছে অনেক বড় ব্যাপার। ধরুন এক সেকেন্ড আগে বা পরে হলে তো ওরা আমাকে দেখতে পেত না। তাহলে আমারও তো আজকের এই অবস্থানে আসা হতো না। তাই আমি অলৌকতায় বিশ্বাসী। আমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা তো অলৌকিক।’
সম্প্রতি ৫০ বছরের জন্মদিন উদযাপন করেছেন স্যাশ সিম্পসন। যদিও নিজের সত্যিকার বয়স জানেন না তিনি। গত বছর নিজের বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন অস্ট্রেলিয়ার এই শীর্ষস্থানীয় সেফ। অথচ আজ থেকে ৪৫ বছর আগে এরকমটা স্বপ্নেও দেখার সাহস পেতেন না শশী। গত অক্টোবরে নিজের বিলাসবহুল রেস্তোরায় বসেই নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিনিধির সাথে কথা বলছিলেন তিনি। তার সগৌরব স্বীকারোক্তি-‘আমি সব পেয়েছি।’
একই সঙ্গে নিজের দরিদ্র ও অনুজ্জ্বল শৈশবের কথাও স্মরণ করলেন । রেললাইনের ধারে এক ঝুঁপড়িতে থাকতো শশীদের পরিবার। বাক প্রতিবন্ধী বাবা কাজ করতেন তামাক কারখানায়। তার বড় আরও দুই ভাই ছিল। বেশিরভাগ রাতেই তারা ট্রেনে উঠানামার কাজ করতো। তাদের মা একদিন তাদের ছেড়ে আরেকজনের সাথে চলে গেলেন। তখন ছোট শশীকে কে দেখে! একদিন তার বড় ভাই বাসস্টেশনে ফেলে আসে তাকে। ব্যস, তার দত্তক নেয়ার কাগজপত্রে এটুকু তথ্যই দেয়া আছে। ‘আমি ভারতের ঠিক কোনও অঞ্চল থেকে এসেছি তা ঠিক জানি না। এতিমখানার কর্মীরা যেখান থেকে আমাকে তুলে এনেছিলেন, আমি সেটাকেই নিজের ঘর বলে জানি।’
শশীকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল যে সংস্থাটি তার নাম ‘ফ্যামিলিজ অব চিলড্রেন’। এটি কানাডার একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সান্ড্রা সিম্পসন। মন্ট্রিলের অধিবাসী ৮৩ বছরের সান্ড্রা সিম্পসন এখনও এই সংস্থাটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি শশীকে নিজের পরিবারেই দত্তক নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৯ সালের এক তুষারঝড়ের দিনে ভারত থেকে কানাডার টরেন্টো শহরে এসে পৌঁছায় বালক শশী। নতুন পরিবারে এসে তো শশীর চোখ ছানাবড়া। এত বড় পরিবার, এত আসবাবপত্র-এগুলো আগে কখনও দেখেনি সে। সেখানেই জীবনে প্রথম টেলিভিশন দেখেছিল শশী। বিশাল বড় ডাইনিং টেবিলে নতুন ভাইবোনদের সাথে খাবার খেত সে। ১৯৮৪ সালে আনুষ্টানিকভাবে সিম্পসনের পরিবার দত্তক হিসাবে গ্রহণ করে শশীকে। সেখানে সবমিলিয়ে ২৬ জন শিশু ছিল যাদের ২০ জনই দত্তক নেওয়া। তাদের বেশিরভাগই এসেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত বা প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ার মতো দেশ থেকে। শশীরা থাকতো ২২ রুমের বিশাল বাড়িতে, যেটি টরেন্টোর অন্যতম ধনী গৃহ হিসাবে বিবেচিত। তো শশীর কর্মজীবন শুরু হয় ১২ বছর বয়সে, পত্রিকা ডেলিভারি বয় হিসাবে। ফলে ওই বয়সেই বেশ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল সে। নিজের পোশাকসহ বিভিন্ন পছন্দের জিনিস ক্রয় করতে পারতো।
১৪ বছর বয়সে টরেন্টোর এক রেস্টুরেন্টে ডিসওয়াসারের কাজ নেয় শশী। এরপর খুব দ্রুত প্রমোশন হতে থাকে তার। ডিসওয়াস থেকে কিচেনে স্থানান্তরিত হয় শশী এবং সেখান থেকেই রান্নায় হতেখড়ি। নানা ধরনের খাবার তৈরিতে হাত পাকাতে থাকে শশী। ততদিনে সে স্যাশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। আমরা এখন তাকে স্যাশ-ই বলতে পারি। রান্না-বান্নয় যতটা আগ্রহ-ততটাই অপছন্দ ছিল লেখাপড়। আর আগ্রহ থাকবেই বা কীভাবে, ছোটবেলায় তো ভিক্ষা করে আর কাগজ কুড়িয়েই দিন গেছে। ফলে কানাডায় এসেও খুব বেশিদিন লেখাপড়া করার ইচ্ছা হয়নি তার। ১২ ক্লাসে উঠেই লেখাপড়া ছেড়ে পুরোপুরি কাজে মনোযোগী হন।
১৯৯৩ সালে খবরের কাগজে একটি বিজ্ঞাপন নজর কাড়ে স্যাশের, একটি বড় রেস্টুরেন্টে লোক নেয়া হবে। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তো চক্ষু চরকগাছ স্যাশের। এ রকম অভিজাত রেস্টুরেন্টে এর আগে কোনও দিন প্রবেশ করারও সুযোগ হয়নি তার। আর সেখানকার কিচেনেই কিনা চাকরি হয়ে গেল স্যাশের, তিন মাস বিনা বেতনে কাজ করার শর্তে। সকাল থেকে রাত অব্দি একটানা কাজ করতেন স্যাশ। কঠোর পরিশ্রমের ফল জুটলো ১০ বছরের মাথায়। ২০০৩ সালে ওই রেস্টুরেন্টের নির্বাহী সেফের দায়িত্ব পান। ততদিনে তার রান্না, পরিবেশন ও অতিথি আপ্যায়নের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে রেস্টেুরেন্টের বাইরেও।
২০০৮ সালে এক ক্যাটারিং ইভেন্টে দেখা মিলে রবিন পিচারের সঙ্গে। ১১ বছরের ছোট রবিনকে মনে ধরে স্যাশের এবং তারা বিয়ে করেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের বয়স ৯ বছর এবং দুই ছেলের বাবা-মা তারা।
তবে বর্তমানে করোনা মহামারির কারণে বেশ সমস্যায় আছেন স্যাশ। লকডাউনে কানাডার অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। এখনও যেগুলো খোলা আছে, খদ্দেরের অভাবে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। তাই গত আট মাসে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পাড় করেছেন এই সেফ। এমনকি ধারের টাকায় রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের বেতন দিয়েছেন। তারপরও দিনের বেশিরভাগ সময় এখনও রেস্টুরেন্টেই কাটে তার। যদিও সেখানে কোনও খদ্দের আসে না। তাই বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রে দেয়ার কথা ভাবছেন স্যাশ। তাই বলে এই সংগ্রামী মানুষটা হেরে গেছেন মনে করার কোনও কারণ নেই। ভারতের রাস্তা থেকে উঠে আসা এই মানুষটি জানেন কীভাবে টিকে থাকতে হয়, লড়াইয়ে জিতে কীভাবে ফেরত আসতে হয়। একদিন ঠিকই উঠে দাঁড়াবে অস্ট্রেলিয়ার এই বিখ্যাত সেফ। আবারও চালু করবেন অভিজাত কোনও রেস্টুরেন্ট যা পরিপূর্ণ থাকবে উৎফুল্ল মানুষের ভিড়ে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে মাহমুদা আকতার
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
আক্রান্ত
১০১৫৫১৬০০
সুস্থ হয়েছে
৭৩৪৫৮৩৭৫
মৃত
২১৮৭১৪৪
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা