প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইওআরএ সদস্য দেশের সমুদ্র তলদেশের অনাবিষ্কৃত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে অভিন্ন টেকসই সমুদ্র অর্থনৈতিক বেষ্টনী গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, সমুদ্র অর্থনীতি সামনে রেখে সমুদ্রে অব্যবহৃত ও অ-উন্মোচিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে যার যার টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে দারিদ্র্যবিমোচন, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তাসহ বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে তৃতীয় আইওআরএ সমুদ্র অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের (ব্ল– ইকোনমি মিনিস্টিরিয়াল কনফারেন্স) উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওআরএ) দু’দিনের এ সম্মেলনের আয়োজন করছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিরা ঢাকায় আসেন। মন্ত্রীরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এদিন কয়েকটি কর্ম-অধিবেশন হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একীভূত টেকসই সমুদ্র অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল পেতে অংশীজনদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয়ের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এ সম্মেলনেই যেন আমরা সম্মিলিতভাবে সমুদ্রসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-১৪ অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি। শান্তি, নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নের মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেয়াল রাখতে হবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে যেন সমুদ্রের সুস্থ পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়।
তিনি বলেন, সমুদ্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সমুদ্র-চিন্তাও করতে হবে। সে লক্ষ্যে সমন্বিত, লাভজনক ও সর্বোপরি সমুদ্র সংরক্ষণমূলক নীতিনির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী কর্মকাণ্ড চালাতে হবে। তবেই ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন মানুষের জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিতে সমুদ্র অর্থনীতিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আইওআরএ মেরিটাইম সুরক্ষা ও নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহায়তা, মৎস্য ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ ঝুঁঁকি ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহায়তা, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সর্বোপরি সমুদ্র অর্থনীতির সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতায় অন্য অঞ্চলের তুলনায় আমরা পিছিয়ে আছি। আপনারা ইতিমধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, সমুদ্রশাসন, সম্পদ উন্মোচন ও আহরণের টেকসই পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
২০১৭ সালে জাকার্তায় আইওআরএ লিডার্স সামিটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সেখানে আমরা আইওআরএ’র নেতৃত্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র অর্থনীতির উন্নয়নে কাজ করার এবং সমুদ্রযান চলাচলের স্বাধীনতায় সম্মান দেখানোর অঙ্গীকার করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ১ অক্টোবর দু’বছরের জন্য আইওআরএ’র সহসভাপতি এবং ১ অক্টোবর ২০২১-পরবর্তী দু’বছরের জন্য সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই গুরুদায়িত্ব পালনে সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সম্মিলিতভাবে কাজ করব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রসম্পদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই জাতির পিতা ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম ‘সমুদ্র অঞ্চলের সীমা নির্ধারণ, সমুদ্র সীমানায় নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট-১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। আইনটি জাতিসংঘের ঘোষণার ৮ বছর আগেই বাংলাদেশে কার্যকর করা হয়, যখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ সম্পর্কে ততটা ধারণাই ছিল না।
সরকারপ্রধান বলেন, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পগুলো যেমন- পণ্য পরিবহন, মৎস্যশিল্প, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সমুদ্রবন্দর, পর্যটন, মেরিন জেনেটিক রিসোর্সেস, মেরিন বায়োটেকনোলজি বিশ্ব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে অবদান রাখছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ ও তেল পরিবহনের ৬০ শতাংশ সাগর-মহাসাগর দিয়েই হচ্ছে। ১৫ বছরে সমুদ্র বাণিজ্যের পরিমাণ ৬ ট্রিলিয়ন থেকে ২০ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা বছরের ৬ মাস মা ইলিশ ও মাছের পোনা আহরণ এবং সমুদ্রের নির্দিষ্ট অঞ্চলে বছরে ৬৫ দিন সব ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করেছি। এর সুফলও মিলছে।
সরকারের ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়ন শেষ পর্যায়ে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য রূপকল্প-২০৪১ প্রণয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান-২১০০ নামে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্যি, মনুষ্যসৃষ্ট নানা কারণে সাগর আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ, পরিবেশ দূষণ, তেল নিঃসরণ, প্লাস্টিক বর্জ্যরে দূষণ, শব্দদূষণ এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তন এসবের অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, এর ফলে সাগর ও মহাসাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য যে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তা-ই নয়, বেশির ভাগ আইওআরএ সদস্যভুক্ত দেশ সুনামি ও সাইক্লোনের মতো দুর্যোগে আক্রান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাগর-মহাসাগর গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নে সৃষ্ট অতিরিক্ত তাপের প্রায় ৯০ শতাংশই শোষণ করে থাকে। সমুদ্রবাস্তু ধ্বংস হলে মানবজাতির অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে উল্লেখ করে তিনি সবাইকে মিলে এই বিপর্যয় মোকাবেলায় কাজ করার আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রকে কেন্দ্র করে সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। সমুদ্রের জৈবসম্পদ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার মৎস্য আহরণের সব ধরনের ক্ষতিকারক পদ্ধতি ও উপায়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন, আমাদের সবার কল্যাণে সমুদ্র অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জনে যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলো এই সম্মেলনে বেশ আলোচনা হবে। তিনি বলেন, সম্মেলন শেষে ‘ঢাকা ঘোষণা’ হিসেবে যা গ্রহণ করা হবে, সেটি ভবিষ্যতে আমাদের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, আইওআরএ চেয়ারপারসন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার পরিবেশ, বন ও মৎস্যসম্পদবিষয়ক উপমন্ত্রী মাখোতসো মেডেলিন সতিও, আইওআরএ মহাসচিব ড. নমভুভো এন নকউই এবং আন্তর্জাতিক সিবেড কর্তৃপক্ষের মহাসচিব মাইকেল ডব্লিউ লজ বক্তৃতা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্র সম্পর্কিত ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, উচ্চ পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিদেশি কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ২২টি সদস্য রাষ্ট্রের সচিবসহ বিশেষজ্ঞরা এবং আইওআরএ’র ৮টি ডায়ালগ পার্টনার দেশ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছে। ১৯৯৭ সালে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী ২১ দেশ নিয়ে আইওআরএ গঠিত হয়। সদস্য দেশগুলো হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, কমরস, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কেনিয়া, মাদাগাসকার, মালয়েশিয়া, মরিশাস, মোজাম্বিক, ওমান, সিশেলস, সিঙ্গাপুর, সোমালিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, তানজানিয়া, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইয়েমেন। জাপান, জার্মানি, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও মিসর আইওআরএ’র ডায়ালগ পার্টনার।
রোহিঙ্গা ইসু্যুতে বাংলাদেশের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সমর্থন অব্যাহত থাকবে : বাসস জানায়, সফররত অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেরিজ পেইন বলেছেন, তার দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি জোরালো সমর্থন অব্যাহত রাখবে। সকালে আইওআরএ সমুদ্র অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি এ আশ্বাস দেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম মন্ত্রী মেরিজের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চাই জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। মানবিক দিক বিবেচনায় অস্ট্রেলিয়া আগামী দিনে আরও সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এই ইস্যুটির সংস্পর্শে থাকতে চাই।
এ সময় শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সংলাপ করেছি এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন নিয়ে চুক্তি হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদেরকে অবশ্যই নিজভূমে ফিরিয়ে নিতে হবে। এটা আমাদের জন্য বড় বোঝা। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক লাখ নতুন শিশু জন্ম নিয়েছে।
ক্রিকেট প্রসঙ্গে কথা হলে মেরিজ পেইন, যিনি কিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতোই এই জনপ্রিয় খেলার একজন ভক্ত, তিনি বলেন, তারা চান অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দল আগামী বছর বাংলাদেশ সফর করুক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় হাইকমিশনার এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা