বুয়েটের কয়েকজন প্রকৌশলী দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেছেন ভেহিকল ট্র্যাকিং ডিভাইস ‘প্রহরী’। প্রহরীতে আছে ২০টির বেশি ফিচার। অ্যাপ ও ওয়েবপোর্টাল—দুই মাধ্যমেই গাড়ি ট্র্যাক করার সুবিধা আছে। বিস্তারিত আজরাফ আল মূতীর কাছে
গাড়ির মালিক হওয়ারও নানা হ্যাপা। এই যেমন—গাড়ি চুরি, ড্রাইভার অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছে কি না, গাড়ির তেল চুরি হচ্ছে কি না, ড্রাইভার কোনো বিপদে পড়ছে কি না ইত্যাদি। এই দুশ্চিন্তাগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হচ্ছে, প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া। আরো ভালো করে বললে, ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া।
এরই মধ্যে এই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে ‘প্রহরী’ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ভেহিকল ট্র্যাকিং ডিভাইস দিয়ে সেবা দিচ্ছে।
ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেমটি কী সহজ করে বলতে গেলে জিপিএসের মাধ্যমে গাড়িকে ট্র্যাক করা এবং গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যে প্রযুক্তি সাহায্য করে, সেটিই ‘ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম’। সাধারণত এই প্রযুক্তির সাহায্যে গাড়ির অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় এবং প্রয়োজনে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে গাড়ির নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যায়।
যেভাবে শুরু অন্যরকম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘অন্যরকম ইলেকট্রনিকস কম্পানি লিমিটেড’-এর হাত ধরে প্রথম বাজারে পা রাখে প্রহরী। শুরু থেকেই প্রহরীর মূল লক্ষ্য ছিল বাইরের প্রযুক্তি ধার করে নয়, দেশীয় প্রযুক্তিতেই ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম গড়ে তোলা। সে লক্ষ্যেই কাজ শুরু করেছিলেন বুয়েটের একদল প্রকৌশলী। ‘পাই ল্যাবস বাংলাদেশ’-এর তত্ত্বাবধানে হয়েছিল এই গবেষণা। সব মিলিয়ে বিটিআরসির লাইসেন্স বুঝে নেওয়া এবং গবেষণা ও উন্নয়নে হাত দেওয়ার সময়কালটা ছিল ২০১২। এরপর বছর দুয়েক কেটেছে গবেষণাকাজে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে শুরু হয়েছিল ওয়েব পোর্টাল ডেভেলপমেন্টের কাজও। ২০১৪ সালে এসে প্রথম ‘প্রহরী’ ইনস্টলেশনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ওই অর্থে বলা যেতে পারে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের রাস্তায় যাত্রা শুরু করে প্রহরী ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম, ‘ডিভাইস ভার্সন ১.০’।
এভাবে শুধু দেশের বাজারে প্রবেশ করে প্রহরী। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এতে যোগ হতে থাকে একের পর এক নতুন আপডেট। ২০১৫ সালে নিজেদের সেবার সঙ্গে প্রহরী যোগ করে অ্যানড্রয়েড অ্যাপ, একই সঙ্গে প্রকাশ করা হয় ‘ডিভাইস ভার্সন ২.০’। আইওএস অ্যাপ তৈরির কাজটিও শুরু হয়ে যায় এই সময় থেকেই। পরে ২০১৬ সালে এসে আইওএস অ্যাপ প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। আর ২০১৮ নাগাদ যথাক্রমে ডিভাইস ভার্সন ৫.০ এবং ৬.০ এবং নিজেদের লাইট প্যাকেজ প্রথম বাজারজাত করা হয়। এই প্যাকেজের মাধ্যমে গ্রাহককে স্বল্প খরচে গাড়ির নিরাপত্তাসেবা নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় প্রহরী।
প্রহরীর সব প্রযুক্তি কি বাংলাদেশের এত কিছু জানার পর, এই প্রশ্ন মনে আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এর উত্তরটা কিন্তু একটু জটিল, এক অর্থে ‘হ্যাঁ’, আরেক হিসেবে ‘না’। ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রযুক্তিতে গাড়িতে একটি মাইক্রো কন্ট্রোলার বসানো হয়, গাড়ির ট্র্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে এই যন্ত্রটির বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে এ ধরনের মাইক্রো কন্ট্রোলার তৈরি হয় না। তাই প্রহরীকে এই যন্ত্রটি সংগ্রহ করতে হয় বাইরে থেকে, বাদবাকি সব হয় এ দেশে।
এ বিষয়ে প্রহরী টিম বিশ্বাস করে, ‘বিদেশি পণ্য বর্জন করুন বলে আমরা আওয়াজ তুলতে পারি; কিন্তু সেটা তত দিন সফল হবে না, যত দিন না আমরা বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে পারছি।’
বাংলাদেশের সড়কপথের কথা মাথায় রেখে নিজেদের ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম সেবা ডিজাইনটি তৈরি করেছে প্রহরী। ফলে তাদের এই সেবা আর দশটি প্রতিষ্ঠানের সেবার তুলনায় কিছুটা আলাদা।
প্রহরীর সেবা ভেহিকল ট্র্যাকিং সিস্টেম প্রযুক্তিতেই একজন গ্রাহককে সব মিলিয়ে ছোট-বড় ২০ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে প্রহরী। এই সেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে লাইভ ট্র্যাকিং, যা গাড়ি চুরি রোধে সাহায্য করে, জ্বালানির খবরাখবরের জন্য মাইলেজ রিপোর্ট ও ফুয়েল মনিটরিং, গাড়ি ঠিকমতো গন্তব্যে পৌঁছেছে কি না জানতে রয়েছে ডেসটিনেশন অ্যালার্ট। এ ছাড়া রয়েছে এসি অন/অফ নোটিফিকেশন, স্পিড ভায়োলেশন অ্যালার্ট, ইঞ্জিন লক/আনলক, ইঞ্জিন অন/অফ নোটিফিকেশন, ট্রাভেল হিস্ট্রি, জিও ফেন্সিং, প্যানিক বাটন, ডেইলি সামারি ও এক্সটেনডেড ডেইলি রিপোর্ট।
গ্রাহকদের এই সেবাগুলো দিতে মোট চার ধরনের রেডি প্যাকেজ রয়েছে—লাইট প্যাকেজ, বেসিক প্যাকেজ, স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজ এবং প্রিমিয়াম প্যাকেজ।
প্রতিটি প্যাকেজের সেবা স্বল্প মাসিক কিস্তিতেই নেওয়া সম্ভব। এসব ছাড়াও আগ্রহী ক্রেতা চাইলে তার মনমতো প্যাকেজও তৈরি করে দেয় প্রহরী। প্যাকেজভেদে খরচ পড়বে চার হাজার ৪৯৯ থেকে ১১ হাজার ৯৯৯ টাকা। মাসিক চার্জ ৪৫০ থেকে ৬৯৯ টাকা।
সেবা ও প্যাকেজের বিস্তারিত নিজস্ব ওয়েবসাইটেই (https://www.prohori.com/) দিয়ে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। অ্যানড্রয়েড এবং আইওএস অ্যাপের লিংকও মিলবে এখানেই। সারা দেশে মোট তিন হাজার ২০০-এরও বেশি ডাটা পয়েন্ট রয়েছে এদের। ফলে পুরো বাংলাদেশই তাদের সেবার আওতায় রয়েছে। এদিকে গ্রাহকের কাছে সহজে নিজেদের সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৭টি অনলাইন মার্কেটপ্লেস রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির; এমনকি আগ্রহীরা চাইলে প্রহরীর ওয়েবসাইট থেকে বিনা মূল্যে সেবার ‘ফ্রি ডেমো’ পর্যন্ত দেখে নিতে পারবেন।
এখন বাংলাদেশের দুই হাজার ৫০০-এরও বেশি গাড়িতে প্রহরীর প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এই সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। প্রহরীর গাড়ির নিরাপত্তাসেবা ব্যবহার করছে ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস, বাপেক্স, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং ওয়েডিং ডায়েরির মতো প্রতিষ্ঠান। একই গ্রাহকের একাধিক গাড়িতে প্রহরীর সেবা থাকলেও ম্যাপে একত্রে না দেখিয়ে প্রতিটি গাড়িকে আলাদা করে দেখায় এই ভেহিকল ট্র্যাকিং সার্ভিস। এ ছাড়া নিজেদের গ্রাহককে ২৪ ঘণ্টা বিক্রয়োত্তর সেবাও দিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান।
প্রহরী টিম প্রহরীর প্রধান টিমের মোট সদস্যসংখ্যা ছয়। এই ছয়জনের প্রত্যেকেই প্রহরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন—সভাপতি মো. মাহমুদুল হাসান সোহাগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আবুল হাসান লিটন, কো-অর্ডিনেটর এস এম তুহিন হাসান, ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর এস এম তাকভীর রেজা, সিনিয়র রিসার্চ ইঞ্জিনিয়ার মো. হাসান-উজ-জামান এবং সিস্টেম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আহসান আল রাব্বি। এঁরাসহ সব মিলিয়ে প্রহরীতে কাজ করছেন মোট ৩০ জন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ভবিষ্যতে নিজেদের সেবার গণ্ডি আরো বড় করতে আগ্রহী প্রহরী। নিজেদের সেবার পরিধি বাড়িয়ে শিশুদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য ‘কিডস ট্র্যাকিং’ এবং বয়স্কদের খেয়াল রাখতে ‘হিউম্যান ট্র্যাকিং’ নিয়ে আসার লক্ষ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এ ছাড়া সম্পদের খেয়াল রাখতে ‘অ্যাসেট ট্র্যাকার’, গাড়িজাতীয় বিভিন্ন ই-কমার্স সেবা, যেমন—পার্কিংয়ের সুবিধা, রাইড শেয়ারিং ইত্যাদির কথাও ভাবছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি যাতায়াত ও যোগাযোগব্যবস্থায় নৈতিক শিষ্টাচার প্রতিষ্ঠায়ও আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটি।
NB:This post is copied kalerkantho
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা