ফজলুল বারী : করোনা ভাইরাস আতঙ্কে এখন বিশ্ব কাঁপছে। এবার চীন থেকে সৃষ্ট এই ভাইরাস নিয়ে বিশ্বের এখন আতঙ্কের বিষয় কখন কে চীন থেকে এই রোগের জীবানু নিয়ে কোন দেশে ঢুকে পড়ে! অস্ট্রেলিয়া তেমন একটি দেশ। চীন থেকে আসা বিমানের অবতরন, বিমান বন্দরের স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্ক কার্যক্রম এখন টিভি চ্যানেলগুলোতে লাইভ দেখানো হয়। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচজন রোগী পাওয়া গেছে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত। নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যে চারজন, ভিক্টোরিয়া রাজ্যে একজন। এদের সবাই সম্প্রতি চীন থেকে এসেছেন। এই পাঁচজনকে সংশ্লিষ্ট এলাকার হাসপাতালগুলোর বিচ্ছিন্ন এলাকায় রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় বড় অংকের চীনা ছাত্রছাত্রী পড়েন। শুধু চীনা ছাত্রছাত্রীদের জন্যে এদেশের নানা অঞ্চলে আলাদা বোডিং স্কুল আছে। গ্রীষ্ম-ক্রিসমাসের লম্বা ছুটি শেষে এদেশের স্কুলগুলো আগামী ৩১ জানুয়ারি খুলছে।
নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্য কর্তৃপক্ষ চিন্তা করেছিল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত পরিবারগুলোর কোন সদস্য থাকলে তাদেরকে বলা হবে তারা যাতে দু’সপ্তাহ স্কুলে না আসেন। কিন্তু এ নিয়ে আতংকিত একটি গ্রুপের উদ্যোগে এর বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। এতে আবেদন জানিয়ে বলা হয় এখন চীন থেকে আসা কোন ছাত্রছাত্রীই যাতে ক্লাসে না আসে। অতঃপর স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পাল্টে বলেছে চীন থেকে আসা সব ছাত্রছাত্রী যাতে আগামী ১৪ দিন যার যার বাড়িতে থাকেন। বাড়িতেই তাদের ক্লাসের পড়া পৌঁছে দেয়া হবে। এভাবে চীন থেকে আসা কোন লোকজনই এখন কোন দেশে ওয়েলকাম করা হচ্ছেনা। পদ্মা সেতুতে চীনা যে সব লোকজন কাজ করেন তারা চীন থেকে ফেরার পর তাদের এখনও কাজে যোগ দিতে দেয়া হচ্ছেনা। সেখানে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে থাকা বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের ফেরত আনা নিয়ে নানা রিপোর্ট হচ্ছে মিডিয়ায়।
উহানে থাকা বাংলাদেশি ছাত্রদের অনেকে প্রায় রাতে দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সংযু্কত হয়ে কথা বলেন। তাদের উদ্বেগ বুঝতে পারি। বয়সও কম। একটি নিরাপদ দেশে গিয়ে নিরাপদ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সেখানে তারা নিজেদের প্রয়োজনে গেছেন। কেউ দাওয়াত দিয়ে নেয়নি বা কেউ সেখানে বেড়াতেও যাননি। যে যেখানে যাবেন সে দেশের সুখেদূঃখের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করবেন। শুধু সুখের সময় সঙ্গে থাকবেন দূঃখের দিনে চলে আসবেন, এই দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের বদলানো দরকার। বিশেষ করে সংগ্রামী নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়ের কাছে আমরা লড়াকু স্বভাবটিই চাই। এক টেলিভিশনে আটকে পড়া শহরে থাকা এক প্রিয় প্রজন্ম বলছিল তার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার সঙ্গে সর্বক্ষনিক যোগাযোগ রাখছে। খাবার পৌঁছে দিচ্ছে বাসায়। বাজার করে দিতে বললে বাজারও করে দিচ্ছে। শুনে মন ভরে গেলো। এমন ব্যবস্থাপনা চীনাদের পক্ষেই গড়ে তোলা সম্ভব। এক ছাত্র বলছিল রোগাক্রান্ত হলে যাতে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এই চিকিৎসার ব্যবস্থা চীনেই ভালো হবে।
মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আটকেপড়া ছাত্রদের দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন, তখন চীন থেকে-দেশে থেকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেবার কথা বাড়তে থাকে। প্রধানমন্ত্রী মা হিসাবে কথাটি বলেছেন। কিন্তু উহান শহরে এর কোন বাস্তব অবস্থাই নেই। সেখানকার বিমান বন্দর বন্ধ। সবকিছু বন্ধ। নতুন কেউ সেখানে যেতে পারছেন না বা কেউ সেখান থেকে বেরুতে পারছেননা।
চীন সেখানে বিশাল এক হাসপাতাল বানাচ্ছে। যেখানে শুধু করোনা ভাইরাস আক্রান্তদেরই চিকিৎসা হবে। গৃহবন্দী থাকায় এখন পর্যন্ত কোন বাংলাদেশি বা কোন বিদেশি এই রোগে আক্রান্ত হয়নি। আক্রান্ত হলে চীনেই এর ভালো চিকিৎসা হবে। বাংলাদেশিরা লড়াকু জাতি। লড়াইটা সেখানে থেকেই করতে হবে। পালিয়ে গিয়ে নয়। এখন ওখান থেকে বেরিয়ে দেশে গিয়েও মর্যাদার হবেনা। তাদের আলাদা করে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হবে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ। করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের রোগ প্রকাশ হতে চৌদ্দ দিন বা এরও বেশি সময় লাগে। কাজে এই পরিস্থিতিতে সেখান থেকে কেউ বেরিয়ে এসে দেশে পৌঁছতে পারলেও তারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারবেননা। যাদের দেশে ফেরা আনন্দের হবেনা, অনেকে তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ন মনে করতে পারেন, তাদের সেখানেই সংগ্রাম করা ভালো নয় কী?
আমার একটা অভিজ্ঞতা বলি। ২০০৬ সালে আমি লেবানন যুদ্ধের খবর সংগ্রহে সে দেশটায় যাই। সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয়। যারা যুদ্ধের কারনে সেখান থেকে বেরিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে দেশে ফেরত যাচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় আমি লেবাননে যাচ্ছি শুনে সীমান্তে পলায়নপর বাংলাদেশি অনেকে বলেন আপনি ওখানে এখন মরতে যাচ্ছেন নাকি! বৈরুত পৌঁছে অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয় তারা বলেন মরি-বাঁচি এখানেই থাকতে হবে। কারন এখান থেকে বেরিয়ে গেলে আবার আসতে পারবোনা। এখানে থাকতে না পারলে দেশে পরিবার-পরিজনকে খাইয়ে দাইয়ে ভালো রাখতে পারবোনা। আমি বৈরুত পৌঁছবার দুই সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধ থেমে যায়। ভিতরে থাকা বাংলাদেশিদের তখন কাজের সুযোগ বেড়ে যায়। শ্রমিক সংকটে তখন একেকজন একাধিক কাজ করতে থাকেন। সংগ্রামীরা এভাবে জীবনের সবক্ষেত্রে বিজয়ী হয়। পলায়নকারীরা কোথাও জয়ী হতে পারেনা।
করোনা ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশের এখন অন্য চিন্তা করে সে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়া উচিত। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সারা দুনিয়া বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে যাচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশ পর্যন্ত পৌঁছবে। বাংলাদেশ কী সেই সংকটের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে? হুশিয়ার বাংলাদেশ।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা