ছবি : তাসকিনা ইয়াসমিন।
তাসকিনা ইয়াসমিন
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ৬০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই অবস্থাটি উদ্বেগজনক বলছেন বিশ্লেষকেরা। বিশ্লেষক মঞ্জু ধর বলছেন, দেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় এটি বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে, গবেষক আফসান চৌধুরী বলছেন, শিশু ধর্ষণ আগেও ছিল, এখনও আছে। তবে, ধর্ষণ কিভাবে বন্ধ করা যাবে সেটা নিয়ে গবেষকদের কাজ করা দরকার।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের গণমাধ্যম উপ-পরিষদের সদস্য মঞ্জু ধর বলেন, দিন দিন দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যদি ধর্ষণের ঘটনায় যদি সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীকে ধরা মাত্রই দ্রুত বিচার করে সঙ্গে সঙ্গে যদি কঠোর শাস্তি দিত তাহলে এটা কমে আসত।
তিনি বলেন, আমরা নারী নির্যাতনের ঘটনায় শুধু নুসরাতের ঘটনায় দেখেছি তার হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে। এছাড়া তনুসহ অন্য মেয়েদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছেনা। শিশু ধর্ষণের ঘটনাতেও আমরা দেখছি, কোন বিচার হয়না। বিচার হীনতার সংস্কৃতিই এখন সবচেয়ে বড়। আগে এত ধর্ষণের ঘটনা দেখিনি।
গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বলেন, বিষয়টা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত, সমাজ আগের চেয়ে বেশি অস্থির তা নয়। কিন্তু এমন কি কারণ ঘটতে পারে যে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হচ্ছে মিডিয়া তথ্য ব্যবহার করে এ ধরণের মন্তব্য করে এক নতুন ধরণের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আগে যেন ধর্ষণ হতো না! আমি ২২ বছর ধরে শিশু যৌন নির্যাতনের উপর কাজ করছি। আমি কোনসময় দেখিনি, ধর্ষণ কম ছিল। এখণ বেড়েছে বলতে কি বোঝানো হয়? এই তথ্যগুলো সূচকী। এগুলো গবেষকদের দেখা উচিত। আমি দেখেছি যে বড় বড় সংস্খাগুলো মিডিয়ার তথ্য থেকে বলছে। কিন্তু মিডিয়ার তথ্য আর গবেষণার তথ্য এক নয়। বাংলাদেশে শিশুদের ধর্ষণ সবসময় হয়েছে। শুধুমাত্র হঠাৎ করে এই ধর্ষণের গবেষণায় মনে হচ্ছে, আগে যেন ধর্ষণ কম হতো!
সাতবছর বয়সী মেয়ের মা গৃহিনী আফরোজা সুলতানা বলেন, আমার নিজের মেয়ে আছে। তাকে নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকি। আমরা যেন ভয়ের সংস্কৃতিতে বাস করছি। সত্যিই কি শিশু ধর্ষণ বন্ধে কিছু করার নেই?
আফসান চৌধুরী বলেন, আগে এত ধর্ষণ হতো, এখনও নিশ্চয় হয়। বেড়েছে বলা হচ্ছৈ, এটা আসলে কতটা! গণমাধ্যমে রিপোর্ট আসছে বলে? নাকি সার্ভে করছে বলে? আমরা শিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে একটা গবেষণা রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি আমার মতে, বাড়ছে কিনা জানিনা। নিশ্চয় মানুষ এখন জানছে। আগে মানুষ জানতে পারত না। মানুষ অনেক বেশি গোপন করত। এখন গোপন কম হচ্ছে। এখন কি লোকে বলবে যে, পরকীয়া বেড়ে গেছে। বাঙালি সমাজে পরকীয়া সবসময়ই ছিল। গত ৫ বছরে পরকীয়ার রিপোর্ট কয়টা এসেছে এখন কয়টা আসে?
তিনি বলেন, আমি মনে করি, শিশুদের যৌন নির্যাতন প্রচণ্ডরকমভাবে বাংলাদেশের সমাজে রয়েছে এবং এটা খুব বেশি রয়েছে। এটা কোনদিন কমেনি। সবসময় ছিল, ভীষণরকম ছিল। আমাকে কেউ জিজ্ঝাসা করে শিশুরা কতভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, আমি ভয়ের চোটে কথাটা বলতে পারবনা। কারণ আমি মনে করি শতকরা ৭০-৮০ ভাগ শিশুই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা যখন ১৯৯৮ সালে সার্ভে করেছি তখন দেখেছি, প্রত্যেকেরই যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু গণমাধ্যমে এ নিয়ে একটাও রিপোর্ট আসত না। ধর্ষণটা কিন্তু খুব স্বল্পসংখ্যক হয়। ধর্ষণ বলতে আমি বুঝি খুব জোর করে তার সঙ্গে পুরো যৌন কর্মটা সম্পন্ন করা। কিন্তু ৯৫ ভাগ হয় যৌন নির্যাতন। তাহলে এটা যদি বাড়ে, তাহলে সেটা কত বেড়েছে চিন্তা করা যায়? ধর্ষণ হয় মাত্র ৫ ভাগ, সেখানে তাহলে ৯৫ ভাগ যৌন নির্যাতন হচ্ছে। এই তথ্যগুলো আমাদের অত্যন্ত চিন্তিত করছে একইসাথে গবেষকদের সাথে যারা এই বিষয়ে কাজ করেন তাদের একটা পদ্ধতিগতভাবে এটি বলা দরকার। সাধারণত যৌন নির্যাতন ধর্ষণের খবর মানুষ দেয়না। শুধু গণমাধ্যমের তথ্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে আরও গবেষণা দরকার। উল্লেখ করে তিনি বলেন, যদি গণমাধ্যমের তথ্য হয় তাহলে আমি এটা খুব একটা গ্রহণ করব না। কারণ গণমাধ্যম আগের চেয়ে বেশি রিপোর্ট করছে। কিন্তু সবসময় এটা ছিল। গণমাধ্যমের সংখ্যাটা গ্রহণযোগ্য না। বাকি যৌন নির্যাতন যে কিভাবে হচ্ছে সেটা কল্পনা করা যায়না! ছেলেদের যৌন নির্যাতন আমরা দেখতে চাইনা।
১৯৯৮ সালে দেশের প্রতি তিনজনে একজন ছেলে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হতো উল্লেখ করে আফসান চৌধুরী বলেন, এখন যৌন নির্যাতন নারীর বিষয় হয়ে গেছে। ছেলে শিশুও সমানভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। ছেলে শিশু ১১-১২ বছর হয়ে গেলে তাদের ধর্ষণ করা কঠিন হয়, কারণ তাদের শরীরে শক্তি চলে আসে। মেয়েদের দ্বিতীয় স্তরের যে যৌন নির্যাতনটা হয় ১০-১৮ বছর সময়ে কারণ তখন তারা সেক্সুয়ালি ম্যাচিউর করে। তখন অনেক মানুষের চোখে তারা পড়ে। অতএব, শিশুদের যৌন নির্যাতন ১২ বছর পর্যন্ত এবং ১২ বছরের উপরে যারা থাকে তাদেরকেও একসাথে হিসেব করা যায়না। খুব ছোট শিশুর যৌন নির্যাতন আর ১০-১২-১৪ বছরের নির্যাতন একেবারেই ভিন্ন। এইবিষয়গুলো যদি আমরা মাথায় রেখে বলি, তাহলে আমাদের কাছে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য তথ্য যাবে এবং হয়ত কেউ কিছু করার চেষ্টা করবে।
মঞ্জু ধর বলেন, এখন দিনদিন এটা বাড়ছে। মানুষের মানসিকতায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। যেহেতু ধর্ষণ পুরুষরাই করছে তাই, তাদের এখন বিবেকই নেই। তাদেরকে বলব, তাদের বিবেককে জাগাতে। আমি জানিনা, এই পুরুষদের কি ধরণের মনোবৃত্তি! তারা শিশুদের পর্যন্ত ধর্ষণ করছে। সবচেয়ে বড় কথা যদি মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হতো তাহলে দেশে ধর্ষণ কমে আসত। দেশে ধর্ষণের বিচার দ্রুত হওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এটাই চাই।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা