অনলাইন ডেস্ক
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সেবার বিপরীতে আদায়কৃত মোটা অঙ্কের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। অভ্যন্তরীণ অডিটে হিসাব করে দেখা গেছে, তিন অর্থবছরে অন্তত ৫৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন হাসপাতালটির ক্যাশিয়ার পদে থাকা মো. আজিজুল হক সেলিম। তদন্তে সত্যতা পেলেও টাকা আদায় করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই কর্মকর্তাকে নোটিশ দিয়ে দায় সেরেছে। অথচ অভিযুক্ত এই কর্মকর্তা কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চাকরি করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন।
হাসপাতালটির আর্থিক রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শয্যা ও কেবিন ভাড়া, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট নানা সেবার বিপরীতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আদায় হয়েছ ১১ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ টাকা। তবে এসবের মধ্যে এক টাকাও জমা হয়নি কোষাগারে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এক কোটি ২১ লাখ ৬৯ হাজার ৬০৫ টাকা আয় হলেও জমা হয়েছে ৮৫ লাখ ২২ হাজার ৫৯০ টাকা। সবশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আয় হয়েছে ৬১ লাখ ৯১ হাজার ৪৮০ টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকে জমা পড়েছে ৫১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০৫ টাকা।
গত তিন অর্থবছরে মোট আয় হয়েছে এক কোটি ৯৫ লাখ ২৯ হাজার ২৮৫ টাকা। এই পুরো অর্থ আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন হাসপাতালের ক্যাশিয়ার মো. আজিজুল হক সেলিম। তবে সরকারি রেকর্ড ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র এক কোটি ৩৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে মোট ৫৮ লাখ ৬৯ হাজার ৩৯০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন ক্যাশিয়ার আজিজুল।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরেও আজিজুল অর্থ জমা না দেওয়ার বিষয়টি অডিট আপত্তিতে ওঠে। এরপরও হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি ক্যাশিয়ারের পক্ষ নিয়ে অডিট নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো একই পদে বহাল রেখেছিলেন ক্যাশিয়ার আজিজুল হককে।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এর মধ্যে আত্মসাৎকৃত টাকা কোষাগারে জমার বিষয়ে ক্যাশিয়ার আজিজুল হক সেলিমকে একাধিকবার চিঠি দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার জবাব দেননি আজিজুল। আবার অর্থ জমা দেওয়ার বিষয়ে কোনো নথি দেখাতে পারেননি তিনি।
জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবদুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম হচ্ছে টাকা আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে জমা দেওয়া। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অনেকগুলো টাকা কেন জমা দেননি, সেটা আমি বলতে পারব না। কারণ আমি দায়িত্ব নিয়েছি সম্প্রতি। আমি এসে দেখলাম যথাযথভাবে টাকা জমা হচ্ছে না। আমি প্রাথমিকভাবে হিসাব করে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের দপ্তরে জানিয়েছি। যতটুকু জানি তারা তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্তের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, টাকাগুলো আদায়ের জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে তাকে চাকরিচ্যুত করার ক্ষমতা তো আমার নেই। তিনি পদে থাকলেও আমার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে লেনদেন থেকে বিরত রেখেছি।
অভিযুক্ত ক্যাশিয়ার আজিজুল হক সেলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকাগুলো হিসাবের জটিলতার কারণে আমি জমা দিইনি। এখন জমা দিয়ে দেব। কী ধরনের জটিলতা— জানতে চাইলে সেটি তিনি আর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
এদিকে, আইনজীবীরা জানান, টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ওই সরকারি চাকরিজীবীর বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইন এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্বে অবহেলার কারণে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুসারে সেলিমকে চাকরিচ্যুতি বা বরখাস্ত করার প্রশাসনিক পদক্ষেপও নেওয়া যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ ও দায়িত্বে অবহেলা করার অভিযোগে তাকে চাকরিচ্যুত করা উচিত। আজকেই তাকে গ্রেপ্তার করে দুদকে সোপর্দ করা প্রয়োজন, যাতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। না হয় যেকোনো মুহূর্তে তিনি পালিয়ে গেলে এ টাকার দায়ভার কে নেবে?
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এতগুলো গরীব রোগীদের টাকা তিনি জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। এর আগে কী বিষয়টি কেউ জানত না। কারা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কিংবা এই আত্মসাতের পেছনে অন্য কেউ জড়িত থাকলে তাদেরসহ মামলা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালটি নগরের আন্দরকিল্লা এলাকায় অবস্থিত। ১৮৪০ সালে এটি একটি ডিসপেনসারি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯০১ সালে এটিকে হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয। ১৯৮৭ সালে হাসপাতালটিকে ৮০ শয্যায় রূপান্তরিত করা হয় ও পরে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ২০১২ সালে ১০০ শয্যা বাড়িয়ে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট করা হয়।