দিল্লীর করোলবাগে শতশত নারীর প্রতিবাদ
ফরিদ হোসেন
সেই দুটো রাত ছিল নারীদেরই রাত। শত শত নারী ঘর থেকে নেমে এসেছিল নয়াদিল্লীর করোলবাগ বাণিজ্যিক এলাকায়। মা এসেছিল কন্যার হাত ধরে, শ্বাশুড়ি এসেছিল পুত্রবধূর হাতে হাত ধরে। এমনকি শিশু কন্যারাও বাদ যায়নি। যে বাবা মা সন্ধ্যা নামলেই কন্যাকে বলে ঘরে ফিরে এসো, যে শাশুমা পুত্রবধূকে বলে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বেরুবে না। যারা ভয় দেখায় ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ’নির্ভয়ার বীভৎস ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড খোদ এই দিল্লীতেই হয়েছিল – একটু রাতে বন্ধুর সাথে ঘুরতে গিয়ে একটি বাসে উঠে পড়েছিল যেখানে যাত্রী ছিল ওরা দুজন। ভুলে কি গেছে সেই ‘নির্ভয়ার’ কথা! কি করে ভুলে যাও এই দিল্লীর রাস্তায় কত নারী ধর্ষণের, যৌন হয়রানি ও যৌন আক্রমণের শিকার হয়!
সেই শহরেরই ৫ ও ৬ ডিসেম্বর পরপর দুরাতে করোলবাগের রাস্তায় নেমে এসেছিল কয়েক হাজার নারী। পুরো এলাকায় সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত শুধুই নারীদের সমাবেশ। কোন প্রান্তে দাদী হাঁটছেন কন্যা বা নাতনীর হাত ধরে, কোন এক ধারে জমায়েত আরেক দল নারীর কেউ আইসক্রীম খাচ্ছে, কেউ বা খেলছে লুডু ও ক্যারাম। কারো হাতে ব্যাডমিন্টনের রাকেট ও ডর্ক। কারো হাতে ক্রিকেট ব্যাট ও বল।
মহাকাশ সবার জন্য উন্মুক্ত, আমাদের মেয়েদের শরীর তা নয়- এমন লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামে দিল্লীর নারীরা।
কেউবা সমবেত সঙ্গীতের ঝর্নাধারা সৃষ্টি করেছে। কেউ বা আপন মনের খুশিতে নাচছে। শুধু যে নারী তা-ই নয়, কোন নারীর হাত ধরে এসেছিল কয়েকজন পুরুষও। তবে তাদের সংখ্যাটচা খুবই কম। করোলবাগের সেই রাতের কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল নারীর হাতে।
ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের একটি উদ্দেশ্য ছিল, ছিল একটি বার্তা। সন্ধ্যা নামলে বা রাত গভীর হলে শুধু নারীরাই – পুরুষরা নহে – মাথা নিচু করে ঘরে ফিরবে অতি পুরনো এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের প্রত্যাখ্যান। উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে এমন এক সময়ে যখন রাজধানী নয়াদিল্লীসহ ভারতজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় : ঘর থেকে রাস্তা, পথ থেকে পার্লামেন্ট সর্বত্র ধর্ষণ বিরোধী শ্লোগান, চিৎকার ও আর্তনাদ। ২০১২ সালের ‘নির্ভয়া’র ধর্ষণ-হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। আসামীদের ফাঁসির হুকুম কার্যকর করার সর্বশেষ আইনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে যখন তখনই হায়দ্রাবাদের শহরের প্রান্তে ধর্ষিত হলো দিশা, আরেক নির্ভয়া। পশু চিকিৎসক তরুণী দিশা সেদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরছিল। রাত ৯টায় একটি টোল প্লাজার কাছে তার স্কুটির চাকা ফেটে যাবার পর কিছুটা বিহ্বল দিশা আক্রান্ত হলো, গণধর্ষিত হলো। এখানেই শেষ নয়। তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো।
এই প্রেক্ষাপটেই করোল বাগে নেমে এসেছিল শত শত নারী। রাতের রাস্তায় নারীর অধিকার চাই, তার নিরাপত্তা চাই। পুরুষ যদি সারা রাত রাস্তায় থাকতে পারে নির্ভয়ে, তবে নারী কেন নয়?
করোলবাগের নারীদের এই মুক্ত ও সুরক্ষা সমাবেশ হয়তো পুরো সমাজের ভয়ংকর চিত্রটি এক্ষুণি পাল্টে দিতে পারবে না। এটাকে নিছকই একটি প্রতীকি উদ্যোগ বলা ভুল হবে না। তবে এই প্রতীকি সমাবেশ যদি আরো হাজারো সমাবেশ সৃষ্টি করতে পারে, নারী যদি নারীর জন্য স্বাধীনতার জায়গা তৈরি করতে পারে তবে পুরুষ হয়তো জায়গা ছেড়ে দিতে পারে। মানছি যে, এটা কোন বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন নয়, সময়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে পরিবর্তন। তবুও করোলবাগের উদ্যোগের মধ্যে কিছুটা হলেও নতুনত্ব আছে, আছে সাহসের ছোঁয়া ও স্ফুলিঙ্গের ঈঙ্গিত।
# লেখক, সিনিয়র সাংবাদিক।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা