ফজলুল বারী : এক কোটির বেশি বাংলাদেশি এখন বিদেশে থাকেন। প্রবাসী এই বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন। বাংলাদেশের প্রানের মনিহার। একেকজন প্রবাসী মানে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। আমরা যতদূরে যাই তত বড় হয় আমাদের জন্মভূমি। বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষও প্রবাসীদের এই অবদানের কথা স্বীকার করেন। এই কিছুদিন আগেও প্রবাসীরা যখন দেশে যেতেন তখন এলাকায় এলাকায় আনন্দের ঢল নামতো। সেই আনন্দের সম্মান শুধু অনুভব করতে পারতেন প্রবাসীরাই। কিন্তু হঠাৎ করে দেশে প্রবাসীদের দেশে ফেরা নিয়ে এলাকায় এলাকায় আনন্দের বদলে ভীতির সৃষ্টি হচ্ছে।
সর্বশেষ ইতালি ফেরত কয়েক প্রবাসীর ছবি নিয়ে দূঃখজনক ট্রল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়েও দূঃখজনক ট্রল করেছেন অনেক প্রবাসী। এক ইতালি প্রবাসী এ অবস্থায় দেশে ফিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাজেকে বেড়াতে যেতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হলে গিয়ে উঠেছিলেন। পুলিশকে খবর দিলে তার সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তাদের সবাইকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এমন ঘটনা প্রবাসী, ভালোবাসার দেশবাসী কারও জন্যেই কাংখিত নয়। কাজেই সংশ্লিষ্ট সবাইকে পুরো বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে।
বিশ্বজুড়ে চলতি নতুন বিপদের নাম করোনা ভাইরাস। চীনের উহান প্রদেশ থেকে এটি এরমাঝে পৃথিবীর অর্ধেক অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে যেহেতু সারা দুনিয়ার ব্যবসা বানিজ্য, সে কারনে রোগটি দুনিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়তে চীনা লোকজন এবং দেশটি ভ্রমন করে আসা লোকের মধ্যে প্রথমে ছড়ায়। কিন্তু চীন এটির ছড়িয়ে পড়া রুখতে যে ব্যবস্থাগুলো নিয়েছিল তা কোন গনতান্ত্রিক দেশে সম্ভব নয়।
সরকারি নির্দেশ অমান্যকারীদের তারা যেভাবে আটক-গ্রেফতার করেছে তা বাংলাদেশে হলে অনেক বড় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়ে যেতো। এর কারনে দেখা যাচ্ছে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত কেউ চীন থেকে আসা লোকজন নন। শুরু থেকে এই নিউজটি অনুসরন করে আমরা জেনেছি চীনে অবস্থানরত কোন বাংলাদেশি এ রোগে আক্রান্ত হননি। এমন কী উহান প্রদেশেও নয়।
বাংলাদেশিরা প্রথম করোনায় আক্রান্ত হন সিঙ্গাপুরে। এরপর দুবাইতে। সেই সব দেশে তারা উন্নত চিকিৎসা পেয়েছেন। এমনকি সিঙ্গাপুরের সরকার সেখানে আক্রান্তদের পরিজনকে আর্থিক সহায়তাও দেয়। চীনের বাইরে করোনা ভাইরাসে প্রথম মহামারী রূপ নেয় ইরানে। এরপর ইতালি-স্পেন এবং ফ্রান্সে। এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া সহ সবদেশেই আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। চীন থেকে আনা অস্ট্রেলিয়ানদের প্রথমে কোয়ারিন্টাইনে রাখা হয় মূলভূমি বিচ্ছিন্ন ক্রিসমাস আইল্যান্ডে।
এরপর ডারউইনের পরিত্যক্ত মাইনিং এলাকায়। অস্ট্রেলিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার ডাটন গিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখান থেকে ফেরার পর তাঁর করোনা ধরা পড়ে। পিটার ডাটন সহ অস্ট্রেলিয়ার তিনজন আইন প্রনেতা এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বিচ্ছিন্ন এলাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। মঙ্গলবার মেলবোর্নের ব্যাংকের এক কর্মীর করোনা পজিটিভ ধরা পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ভীতসন্ত্রস্ত সব কর্মী রাস্তায় বেরিয়ে যায়। এরপর তাদেরকে বাড়ি থেকে অনলাইনে কাজ করতে বলে দেয়া হয়েছে।
করোনায় ভয়ে রানী এলিজাবেথকে তাঁর মূল বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী গিয়েছিলেন লন্ডনে। সেখান থেকে ফেরার পর তাঁর করোনা ধরা পড়লে প্রধানমন্ত্রীও চলে গেছেন আইসোলেশনে। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে দেশে ফিরেই করোনায় আক্রান্ত হন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। করোনার কারনে জরুরি অবস্থা ঘোষনা করা হয়েছে আমেরিকায়।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্য ইতালিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি বাস করেন। রোগটি সেখানে মহামারীর রূপ নেয়ায় প্রবাসীদের অনেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরতে উদ্যত হন। অনেকের দেশে থাকা বাবা-মা চান ছেলে দেশে ফিরে আসুক। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের যে সামাজিক পারিবারিক বন্ধন, সবাই একসঙ্গে মিলে মিশে থাকেন-এমনকি গ্রামে এক চৌকি বা খাটে যেভাবে থাকেন তাতে করে হোম কোয়ারিন্টানের যে কড়াকড়ি তা বাংলাদেশের খুব কম পরিবারে প্রতিপালন করা সম্ভব।
এতে করে এমন বিদেশ ফেরতদের মাধ্যমে দুটি এরমাঝে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ফেরত একজনের মাধ্যমেও আক্রান্ত হয়েছেন একজন। এসবের কারনে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের প্রবাসী ভীতি। যার যৌক্তিক কারনও আছে।
কারন এই রোগটির উৎস ভূমি বাংলাদেশ নয়। বাংলাদেশের ডেঙ্গু আক্রান্ত একজনকে এডিস মশা কামড়ে গিয়ে আরেকজনকে কামড়ালে তারও ডেঙ্গু হয়। কিন্তু এই করোনা ছোঁয়াছে রোগ। ভাইরাসটি হাঁচি, করমর্দন, কোলাকুলি, চুম্বন থেকে ছড়ায় আরেকজনে। করোনা আক্রান্ত একদেশ থেকে আসা একজন সুস্থ মানুষ নীরবে যে ভাইরাসটি তার পরিবারে-পরিবেশ-গ্রামে বহন করে আনছেন তা তারা বুঝতেই পারছেননা।
এমনিতে একজন প্রবাসী দেশে এলে পরিবারের লোকজন খুশি হন। দেশে ফিরে অনেকে বলছেন তাদের অভিজ্ঞতায় বিমান বন্দরের করোনা পরীক্ষার বিষয়টি মামুলি-দায়সারা! আসলে এটিই বাংলাদেশের অনেক প্রশাসনের দক্ষতা-যোগ্যতা! এমন অবস্থায় দেশে যারা যাচ্ছেন তারা কী ঠিক করছেন?
করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে ছেলে বা মেয়ে ফেরায় খুশি হচ্ছেন মা-বাবা। পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু সেই প্রার্থিত প্রবাসীর মাধ্যমেই যখন করোনা ছড়ালো পরিবারে-দেশে তাতে তা উদ্বেগ-গালিতে পরিণত হয়ে গেলো! এই রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্ত্রাজ্য-ইতালি-জার্মানি-ফ্রান্স বা অস্ট্রেলিয়া যে সব অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষনা করেছে অত সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে কী? অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে হোম কোয়ারিন্টানের ব্যাপারে যে সচেতনতা বা কড়াকড়ি আছে বাংলাদেশে যে তা নেই তাতো এরমাঝে কয়েকটি শনাক্তকৃত ঘটনায় স্পষ্ট। বাংলাদেশ যে গাদাগাদি মানুষের দেশ, তা যদি শহরে-গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তা করুন ঘটনার জন্ম দিতে পারে।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর মূল জাতীয় অনুষ্ঠানের অনেক কিছু বাতিল করেছে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ টেলিভিশনে দেখা বেশ কিছু অনুষ্ঠানে মাস্কবিহীন জনসমাবেশ দেখে ভয় করেছে। এই অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারনা চলছে ঢাকা-১০ এবং চট্টগ্রাম সিটিতে! এসব প্রচারনার মিছিল দেখেই কিন্তু এখন ভয় করে! কারো একজনের করোনা ধরা পড়লেই কিন্তু দোষ হয়ে যাবে কোন এক প্রবাসীর! কারন এখন কোন একজন প্রবাসী ছাড়া কিন্তু এটি দেশে বয়ে নেবার কোন মাধ্যম নেই!
অতএব প্রিয় প্রবাসী। আপাতত দেশে যাওয়া পরিহার করুন। কারন আপনি নিজেও জানেননা যে এর বাহক হয়ে যেতে পারেন আপনিও। দেশে যদি কোনভাবে আপনার মাধ্যমে পরিবারের কারও শরীরে এই ভাইরাসটি ছড়ায়, এরচেয়ে দূর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে প্রিয় প্রবাসী? অতএব ভাবুন দশবার। এরপর এখন দেশে যাবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিন। বিদেশে আপনি-আপনারা বাংলাদেশের গর্বিত রাষ্ট্রদূত।
সেই আপনি-আপনারা হবেন করোনা ভাইরাসের বাহক দূত? সৃষ্ট ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করেছে। দেশের স্বার্থে এই সিদ্ধান্তকেও স্বাভাবিকভাবে নিন। কারন শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত সহ অনেক দেশই এখন একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজেই এখন যে যেখানে আছেন, সেখানেই নিরাপদে থাকুন। প্রিয় প্রবাসী, আপনাদের বলছি।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা