অনলাইন ডেস্ক
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় অবস্থান করেন।
বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলেও সেদিকে নজর না দেওয়ায় এ বছরে ডেঙ্গু ব্যাপক হয়ে উঠেছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন। একসময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও গত কয়েক বছর ধরে বছরজুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। ফলে এ রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
এবার আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে তার পরীক্ষা করে দেখতে হয় কোনো জটিলতা আছে কি না। এ জন্য রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম ও বুকের এক্স-রে করতে হয়। হাসপাতালে রোগী অনেক বেশি হওয়ায় সবার এ পরীক্ষাগুলো করা সম্ভব হচ্ছে না। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ঢাকায় ম্যানেজমেন্ট যেভাবে হচ্ছে, বিশেষ করে বড় ও ভালো হাসপাতালগুলোতে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু চিকিৎসার অবস্থা খুব একটা সুখকর নয়। ডেঙ্গুর চিকিৎসা সহায়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না অধিকাংশ সময়। এ ছাড়া চিকিৎসক-নার্স
স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেঙ্গু শনাক্ত থেকে শুরু করে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাদের এ সেবা পেতে প্রাণপণ লড়াই করতে হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত ও পরবর্তী পরীক্ষা করাতে ভোগান্তির শেষ নেই। সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণে এনএস১ পরীক্ষার মূল্য ৫০ টাকা, আর বেসরকারি হাসপাতালে ৩০০ টাকা। স্বল্পমূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এরপর রিপোর্ট নেওয়ার সময়ও দাঁড়াতে হচ্ছে লম্বা লাইনে। এভাবে পরীক্ষার রিপোর্ট নেওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তির অনুমতি মিলছে। সিট না পাওয়ায় অন্যের সঙ্গে শয্যা ভাগাভাগি করে অথবা ফ্লোরে চলছে চিকিৎসাসেবা। তারপরও মানুষ নিরুপায় হয়ে ছুটছে হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজীর আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গুর চিকিৎসা কঠিন তা নয়,
এর চিকিৎসায় মূলত ফ্লুইড মেইনটেন করতে হয়। এ চিকিৎসার জন্য কয়েকটি জিনিস দরকার হয়। প্রথম হলো পরীক্ষা। এ পরীক্ষা সহজে করার ব্যবস্থা থাকা এবং সেটি সময় মতো করতে পারা। এ জায়গায় কিছুটা সমস্যা আছে। প্রথম সমস্যা হলো সবখানে এ পরীক্ষা হয় না। দ্বিতীয়ত, লক্ষণ যেহেতু অন্যান্য বছরের দেখা ডেঙ্গুর মতো নয়, তাই রোগী বুঝতে পারছে না যে তার ডেঙ্গু হয়েছে। এ বুঝতে না পারার কারণে দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছে। এতে রোগীর রক্তপ্রবাহ থেকে জলীয় অংশ বের হয়ে যায়। আর তখন তার হাইপারটেনশন এবং শক সিনড্রোম শুরু হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বেশির ভাগ ২-৩টি হাসপাতালে বেশি যাচ্ছে। হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি দেখা যাচ্ছে । এতে রোগীর চিকিৎসা সঠিকভাবে হচ্ছে না।
অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, যখন কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলো তখন তার পরীক্ষা করে দেখতে হয় কোনো জটিলতা আছে কি না। এটি দেখতে রক্ত, আলট্রাসনোগ্রাম ও বুকের এক্স-রে করতে হয়। যেহেতু হাসপাতালে রোগী অনেক বেশি, তাদের এ পরীক্ষাগুলো করাটা অনেক সময় কুলানো যাচ্ছে না। যেখানে পরীক্ষা করা দরকার, সেখানে করা যাচ্ছে না।
অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, ঢাকায় যেভাবে ডেঙ্গু চিকিৎসা চলছে সেভাবে এগোচ্ছে না ঢাকার বাইরে। সেখানে পরীক্ষা করা কঠিন হচ্ছে, চিকিৎসক-নার্স স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি আছে। আবার ডেঙ্গুর চিকিৎসা সহায়ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলো রোগীর চাপ বেড়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে এমন দৃশ্যই চোখে পড়ে। হাসপাতালটির মেডিসিন ও শিশু ওয়ার্ডের শয্যা ছাড়াও ফ্লোর, করিডোরে রোগীরা মাদুর পেতে অবস্থান নিয়েছেন। অতিরিক্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেকটাই ক্লান্ত চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। এভাবে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকলে তাদের জায়গা দেওয়া কঠিন হবে বলে তারা জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের ২১০ নম্বর ওয়ার্ডে শয্যা আছে ১৪টি। প্রতি শয্যায় রাখা হচ্ছে দুজন করে রোগী। এরপরও মেঝেতে রাখা হয়েছে অনেক রোগী। তাদের শুশ্রূষা দিতে ওয়ার্ডে থাকছেন দেড় শতাধিক মানুষ। ওয়ার্ডের ভেতর গাদাগাদি ও গরমের কারণে সুস্থ মানুষেরও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এর মধ্যেই চলছে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার লড়াই।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল-২-এর দোতলায় রিপোর্ট ডেলিভারি সেন্টারের সামনে কথা হয় এক রোগীর স্বজনের সঙ্গে। এস রহমান নামের ওই ব্যক্তি বলেন, তার স্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুর টেস্ট করাতে যে ভোগান্তি, তা সবার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। এরপরও যাদের ডেঙ্গু পজেটিভ পাওয়া যায়, তাদের প্রতিদিন বা এক দিন পরপর সিবিসি পরীক্ষা করাতে হয়। এখানে সিবিসির নমুনা যেদিন দেওয়া হয়, সেদিন বিকালেই রিপোর্ট ভেলিভারি দেওয়া দরকার। অথচ এখানে দেওয়া হয় তার পরদিন। বিলম্বে সিবিসি রিপোর্ট দেওয়ায় অনেকের প্লাটিলেট কমে মৃত্যু জটিলতা তৈরি হতে পারে। আইজিএম ও আইজিজি টেস্ট হয় না। এগুলো বাইরে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে করতে হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। ব্লাড ব্যাগের দাম বেড়ে গেছে। হাসপাতালে ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ডেঙ্গু রোগী বাড়ার পর রক্তের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে; কিন্তু ব্লাড ব্যাগের সংকটের কথা বলে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছর ব্লাড ব্যাগের দাম ছিল ৩৫০ টাকা, যা এ বছর ৫০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছর যে ব্লাড ব্যাগ ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তার দাম ৩৫০ টাকা। বাধ্য হয়ে বেশি দামে ব্যাগ কিনছি, অনেক রোগীর স্বজন ব্যাগের দাম বেশি বলে হৈচৈ করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েছে। রোগীদের চাপ সামলাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
তথ্য বলছে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৪ সালে। তখন এই রোগটি ‘ঢাকা ফিভার’ নামে পরিচিত ছিল। এরপর ২০০০ সালে এই রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর পর থেকে কোনো বছর বেড়েছে, আবার কোনো বছর কমছে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় রোগটি নিয়ে মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল। চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ আগের সব প্রবণতা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ১৪ হাজার ৯৯৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আর চলতি বছরের জুলাই মাসের ২১ দিনেই ৩০ হাজার ৬৮৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ চিত্র বলে দিচ্ছে এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে!
২৩ বছরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ চিত্র :
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুজ্ব রে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলেন ৫৫৫১ জন এবং মারা গেছেন ৯৩ জন। এরপর ২০০১ সালে আক্রান্ত ২৪৩০, মারা গেছেন ৪৪ জন। ২০০২ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২৩২, মারা গেছেন ৫৮ জন। ২০০৩ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮৬, মারা গেছেন ১০ জন। ২০০৪ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৩৪, মারা গেছেন ১৩ জন। ২০০৫ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১০৪৮, মারা গেছেন ৪ জন। ২০০৬ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ২২০০, মারা গেছেন ১১ জন। ২০০৭ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৬৬, ২০০৮ সালে ১১৫৩, ২০০৯ সালে ৪৭৮ এবং ২০১০ সালে ৪০৯ জন আক্রান্ত হলে কেউ মারা যাননি। এর পর ২০১১ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ১৩৫৯, মারা গেছেন ৬ জন, ২০১২ সালে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭১, মারা গেছেন একজন। ২০১৩ সালে আক্রান্ত হয় ১৭৪৯ এবং মারা যায় ২ জন। ২০১৪ সালে আক্রান্ত হয় ৩৭৪ এবং কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে আক্রান্ত হয় ৩১৬২ এবং মারা যায় ৬ জন। ২০১৬ সালে আক্রান্ত হয় ৬০৬০, মারা যান ১৪ জন। ২০১৭ সালে আক্রান্ত হন ২৭৬৯, মারা যান ৮ জন, ২০১৮ সালে আক্রান্ত হন ১০ হাজার ১৪৮, মারা যান ২৬ জন, ২০১৯ সালে আক্রান্ত ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪, মারা যান ১৬৪ জন, ২০২০ সালে আক্রান্ত ১৪০৫, মারা যান ৭ জন, ২০২১ সালে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪২৯, মারা যান ১০৫ জন, ২০২২ সালে আক্রান্ত ৪৪ হাজার ৮০২, মারা যান ১৮২ জন।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা