তাসকিনা ইয়াসমিন : বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও যখন ৪৮ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দুজন চিকিৎসক এবং একজন নার্স আছেন তখন একটি গ্রুপ ফেসবুকে পেইজ খুলে পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) বিক্রি করছে। আর এগুলোর কোনটিই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা (হু) নির্ধারিত নিয়ম মেনে করা হচ্ছে না। যার ফলে, এতে করে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বেশি মাত্রায় বাড়ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই অবস্থায় অবিলম্বে হু নির্ধারিত পিপিই সরকারিভাবে দেয়ার জন্য বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফেসবুক অনলাইন পেজে গিয়ে দেখা যায়, কভার এন গ্যাজেট, বেস্ট ডিল ডটকম, কিছু কিনি- এই ধরণের বিভিন্ন নামের ফেসবুক পেজ থেকে পিপিই বিক্রি করা হচ্ছে। এগুলোর মূল্য কোথাও ১২শ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা। একটি অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান লিখেছে, ‘গরম ও স্বস্তা টাপেটা কাপড়ে নয়, বায়ু ও পানি নিরোধক প্যারাসুট কাপড়ে তৈরি পিপিই পাবেন আমাদের কাছে, যা আপনাকে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে বাচতে সাহায্য করবে। প্যারাসুট ফেব্রিকের তৈরি পিপিই ড্রেস পড়ে থাকতে পারবেন দীর্ঘসময়।। এতে অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হয় না।
নিরাপদ ও সংক্রমণের ঝুকিমুক্ত ‘পিপিই’ পোশাক কিনতে চাইলে অর্ডার করতে পারেন ইনবক্সে..# এই ‘পিপিই’ ওয়ানটাইম নয়, এটা ওয়াশেবল.. সারাবছর ব্যবহার করতে পারবেন।’ এইভাবে বিভিন্নভাবে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
চিকিৎসকেরা বলছেন, হু নির্ধারিত পিপিই ছাড়া কোন পিপিই বলে কেউ যদি করে সে উল্টো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে। একজন চিকিৎসক যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় তাহলে সে যতজন রোগী দেখবে তাদের সবার মধ্যেই সংক্রমণ ঘটবে। তাই, হু নির্ধারিত পিপিই শুধু চিকিৎসকদের ব্যবহার করা উচিত। আর শুধু স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ই চিকিৎসকদের দিতে পারে। অন্য কেউ নয়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তারা কেন নিজে পিপিই কিনবেন? আর যদি করোনা ভাইরাসের সন্দেহজনক যদি কোন রোগী আসে সেই রোগীকে তারা দেখবেন কেন? কারণ একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হলে শুধু তিনি একজন ব্যক্তিই আক্রান্ত হচ্ছেন না, তার সংস্পর্শে যারা আসছে তাদের সবারই করোনা ঝুঁকি উনি বাড়িয়ে দিচ্ছেন। একজন বিবেকবান চিকিৎসক, দায়িত্বশীল কোন চিকিৎসক এই কাজটি করতে পারেন না। সেইজন্য তাকে করোনা সন্দিহান অথবা করোনা রোগী চিকিৎসার জন্য হু স্বীকৃত করোনা প্রটেকটিভ পিপিই ব্যবহার করতে হবে। এবং বাংলাদেশের বাজারে কোন যায়গায় এই ধরণের পিপিই পাওয়া যায়না। সুতরাং সরকারি সোর্সই এই ধরণের পিপিই পাওয়া যাবে। সুতরাং সরকারেরই দায়িত্ব এই পিপিই নিশ্চিত করা।
চিকিৎসকেরা বলছেন, যারা পিপিই আছে এবং দেয়া আছে বলছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন আপনাদের এই পিপিইগুলো হু স্বীকৃত করোনা ভাইরাস প্রটেকশনের জন্য উপযুক্ত কিনা! মানসম্মত কিনা! মানসম্মত যদি না হয়, তাহলে এই ধরণের পিপিই বাজারে দিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে কিনা! সময়ের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে এবং করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কিনা এই প্রশ্নগুলো বারবারই আসছে। পিপিই নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। মানুষের জীবন নিয়ে তো ব্যবসা হতে পারে না!
চিকিৎসকেরা বলছেন, পিপিই বিক্রি করার জিনিস না। পিপিই যদি সবাই বানাতেই পারত তাহলে বিশ্বজুড়ে পিপিই’র এত সংকট হতো না। যারা পিপিই নামে বানাচ্ছে তারা অপরাধ করছে। তারা মানুষের মিথ্যে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলছে। একজন মানুষ জানছে যে পিপিই’র মাধ্যমে সে নিরাপদ কিন্তু সে করোনা রোগীকে ধরার পর সে নিজেও এফেক্টেড হচ্ছে। তার মাধ্যমে, পরিবার, সমাজ এবং জাতি আক্রান্ত হচ্ছে। একটি জাতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে।
একজন চিকিৎসক বলেন, একজন সামরিক বাহিনীর যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে গেলে তাকে প্রথমে প্রয়োজনমতো ট্রেনিং দিতে হয়। এরপর অস্ত্র দিতে হয়। তারপর তাকে যুদ্ধে পাঠানো। বাংলাদেশের করোনা ভাইরাসের মূল যোদ্ধা যারা চিকিৎসক তাদেরকে ড্রেসই আপনি দিতে পারছেন না ঠিকমতো, কিম্বা দিলেও সেটা নিয়ে সন্দিহান তাদের মধ্যে। এই ব্যাপারে অবশ্যই কাজ করতে হবে। আপনি যে ড্রেসটি সেটি যেন সব চিকিৎসক যেন বিশ্বাস নিয়ে ব্যবহার করতে পারে।
এ বিষয়ে সিনিয়র চিকিৎসক চিন্ময় দাস বলেন, পিপিই রাস্তাঘাটে পাওয়া সম্ভবনা। পিপিই দুই ধরণের আছে। এটা ওয়ান টাইম ইউজ হয়। আর একটা রি-ইউজেবল হয়। পিপিই ইউজ করা খুব টেকনিক্যাল ব্যাপার। যে খুশি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা আসলে জানেনা এগুলো কিভাবে ইউজ করতে হয় । আমরা যারা মেডিকেল প্রফেশনালিস্ট তারাই এগুলো নিয়ে কথা বলতে পারব। অন্য কেউ পারবে না। সুতরাং এগুলো খুব ভুয়া জিনিস। নানানজন নানাভাবে বিক্রি করছে। এটা ঠিক কাজ হচ্ছে না।
সিনিয়র চিকিৎসক নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, দেশে এখন পিপিই নামে যেগুলো বিক্রি হচ্ছে, সেগুলো আসলে ট্র্যাকস্যুট। পিপিই অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ডিজাইনের হতে হবে। তাহলেই সেটি হবে মানসম্মত। এটি পেলে এমনিতেই আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে কনফিডেন্স পাব। আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং আমি রোগী দেখার অনুপ্রেরণা পাব।
বিষয়টি নিয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ বলেন, পিপিই ইচ্ছা করল আর যেকেউ বানিয়ে বাজারে বিক্রি করল এটি হবেনা। পিপিই ডাব্লিউ এইচওর গাইডলাইনে ডাক্তারদের প্রোটেকশন দেয়া যাবে সেটা মেইনটেইন করতে হবে। সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা এই গাইডলাইন অনুযায়ী বানাচ্ছে। তাদেরটাই শুধু গ্রহণযোগ্য। সেটাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গ্রহণ করছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাপ্লাই দিচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেরা যারা বানাচ্ছে তারা আমার মনে হয় না এই গাইডলাইন মেনে বানাচ্ছে। এটা সবাইকে বানানোর সুযোগ দেয়া ঠিক হবে না। এই পিপিই ওয়াটার প্রুফ হতে হবে। এটি না হলে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হবে। তাদের সুরক্ষা থাকবেনা।
তিনি বলেন, ডাব্লিউএইচও’র প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, আমাদের যে প্রতিষ্ঠানগুলো পিপিই তৈরি করছে। তারা প্রতিদিন ৩০-৪০ হাজার পিপিই তৈরি করছে। ইতিমধ্যে আমি যতটুকু জানি সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, উপজেলা হাসপাতালে পিপিই পৌঁছে গেছে। তারা সেগুলো ইউজ করছে। এগুলো আরও যাবে। এখন একটা রেগুলার প্রসেসে চলে এসেছে। আমার মনে হয় না, পিপিই’র আর সংকট হবে।
এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে তিন লাখ ১৭ হাজার ৫শ পিপিই বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
করোনা পরিসংখ্যান এর লাইভ আপডেট দেখুন
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা