আনন্দ আর কষ্টে মোড়ানো বিজয় দিবস!
তাসকিনা ইয়াসমিন
সেপ্টেম্বরে আমি গাইবান্ধা অঞ্চল থেকে যুদ্ধ করে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে আমার ক্যাম্পে ফিরে যাই। সেখান থেকে একটি বড় দলকে উচ্চতর প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় শিলিগুড়ির পানিঘাটায়। এ সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নতুন বাঁক নিতে শুরু করে। এর আগে প্রধানত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হতো সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যারা প্রশিক্ষণ নেয় তাদের মধ্যে থেকে কিছ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠন করা হয় তুফানী ব্যাটেলিয়ান। তিনটি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত এ তুফানী ব্যাটেলিয়নের কোম্পানি কমান্ডার নিযুক্ত হন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এই তুফানী ব্যাটেলিয়নকে পাঠানো হয় ভারতের পশ্চিম বাংলার বালুরঘাট সীমান্তে। সেখানে চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতেকলমে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এই সীমান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনে সীমান্ত পাহারা রাতে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ঢুকে পাক-বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে হামলা চালাতে হতো।
ডিসেম্বর শুরু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই। ৩ ডিসেম্বর আমরা দিনাজপুরের বিড়ল সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। ততদিনে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়েছে, আমরাও হয়ে পড়েছি যৌথ বাহিনীর অংশ। আমাদের পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে ভারতীয় পদাতিক বাহিনী, ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের সহযোদ্ধারা, আকাশ থেকে বিমান বাহিনী সহযোগিতা করছে আমাদের। আর ছুটে পালাচ্ছে পাক-সেনা ও তার সহযোগিরা ঢাকার উদ্দেশ্যে। এভাবেই সম্ভবত ১১ ডিসেম্বর আমরা পৌঁছে যাই গাইবান্ধার (বর্তমান জেলা) গোবিন্দগঞ্জ পার হয়ে গোলাপবাগে, ক্যাম্প করা হয় সেখানকার একটি কলেজে। পরবর্তী অগ্রযাত্রার আগে সামান্য জিরিয়ে নেওয়া। শোনা গেল, বগুড়া জড় হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন ঘাঁটি থেকে পালিয়ে আসা পাক-সেনারা। সেখানে জোর লড়াই হতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের ফলইন করানো হলো। আমি জরাক্রান্ত বলে বাদ পড়ে গেলাম আরো কয়েক জনের সঙ্গে। কোম্পানি কমান্ডার মেজর মতিলাল চক্রবর্তী শান্তনা দিলেন, ঔষধপত্তর খেয়ে নিজে সুস্থ হও। তারপর যোগ দেবে অগ্রযাত্রায়। ফলে বসে থাকতে হলো গোলাপবাগেই। আমাদের ব্যাটেলিয়ান এগিয়ে গেল সামনে। অবরোধ করলো বগুড়ায় অবস্থানরত পাক-সেনাদের। তখন আমাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো রেডিওর নব ঘুরিয়ে বিভিন্ন রেডিও থেকে মুক্তিযুদ্ধের খোঁজ নেওয়া আর গোলাপবাগ এলাকার জনগনের সঙ্গে কথা বলা আর শোনা।
সারাদিন উত্তেজনায় থাকি, মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা কতদূর? এদূর চলে আসতে পেরেছি, মানেই বিজয় নিশ্চিত! দিনক্ষণ গুনি যে পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের আর কয় ঘন্টা বাকি? তখন যৌথ বাহিনীর পক্ষ থেকে জেনারেল মানেক শ’র কণ্ঠে বার বার বলা হচ্ছে, ‘হাতিয়ার ডাল দো’ মানে হাতিয়ার ফেলে দিয়ে আত্মসমর্পণ করো। জনগণের সঙ্গে কথা বলি। তারাও আমাদের মতোই উত্তেজনায় টগবগ করছে। তাদের উত্তেজনা আমাদের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং বেশীই। কারণ তাদের দেশ স্বাধীন হচ্ছে। তাদের মাথার ওপরে আর খবরদারি করার কেউ থাকবে না, থাকবে না শোষন-বঞ্চনাও। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে ঘুমাতে পারবে নিশ্চিন্তে। তাই তারাও চাইছিল বিদেশি পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটুক দ্রুত।
১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই প্রত্যন্ত গোলাবাগ থেকে শোনা যেতে লাগলো যে, আজই আত্মসমর্পণ করবে পাক-সেনারা। কিন্তু যতক্ষণ আত্মসমর্পণ না করছে ততক্ষণ স্বস্থি নেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগনের মধ্যে। অবশেষে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ, বিকেল ৫টা। মাঠের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার মিলনমেলা। উচু টুলের ওপর রাখা আছে রেডিও। রেডিওতে প্রচার হলো পাক-সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর। কিছুক্ষণ নীরবতা, যেন অভূতপূর্ব আনন্দের খবরে জনতা বাকরূদ্ধ। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। আগ্নেগিরির অগ্নূৎপাতের মতোই কেউ একজন বলে উঠলো ‘জয়বাংলা’। সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠলো মুক্তিযোদ্ধা-জনতা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো প্রাঙ্গন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, শুধু গোলাপবাগ স্কুল প্রাঙ্গণই নয়, আশপাশ এলাকাও মুখরিত হয়ে উঠেছে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে। আশপাশের গ্রামগুলো থেকেও ধ্বণিত হচ্ছে একই শ্লোগান ‘জয়বাংলা’। বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়ে গেছে মিছিল, স্বাধীনতার উৎসবের মিছিল।
রং মাখানো এ স্মৃতি কোনও দিনই ভোলার নয়, বরং সে রং ছড়িয়ে পড়বে অনাগত দিনেও।
# মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্পকার এবং সাংবাদিক।
ফেসবুক পেজ :
আরও পড়ুন : একদিকে বিজয়ের উল্লাস, অন্যদিকে প্রিয় দুই শিক্ষকের মৃত্যু আমাকে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল : ডা. মাগদুমা নার্গিস রত্না
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা