অনলাইন ডেস্ক
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সম্মাননা স্মারক প্রত্যাখান
২০২৪ সালের ১২ অক্টোবর ছিল বেরোবি ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সেদিন উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্বোধন করা হয় শিক্ষার্থীদের বহুল কাঙ্ক্ষিত প্রধান ফটক। তবে দিনটি শুরু হয়েছিল নেতিবাচক খবরের মধ্য দিয়ে। এদিন প্রধান অতিথি হিসেবে পাওয়া সম্মাননা স্মারক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।
বেরোবি প্রশাসনের আমন্ত্রণে ক্যাম্পাসে আসেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। প্রধান ফটক উদ্বোধন, শোভাযাত্রা শেষে দুপুর ২টায় বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। এ সময় শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন জুলাই-পরবর্তী সময়ে এসেও মঞ্চে আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টদের সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়েছে। যা জুলাই যোদ্ধাদের কাম্য নয়।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নাহিদ ইসলাম বলেন, এ (বেরোবি) বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য এসেছেন। তার কাছে আমার আবেদন থাকবে, যাতে এসব বিষয়কে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। আপনারা যে অভিযোগ করলেন বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু এ মঞ্চ থেকে যারা ক্যাম্পাসে আওয়ামী লীগ এবং স্বৈরাচারের দোসর তাদেরকে স্মারক সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। ফলে একই মঞ্চ থেকে আমাকে যে সম্মাননাটি দেওয়া হয়েছে, এটি আমি গ্রহণ করছি না। হয়তো কোনো একদিন ফ্যাসিবাদমুক্ত এ বেরোবিতে আসব। আপনাদের সব দাবি পূরণ করার সক্ষমতা নিয়ে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়াবো। সেদিনই আমি এ সম্মাননাটি গ্রহণ করব।
সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ
২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর সিন্ডিকেট সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী সাংবাদিকদের এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্রিফ করেন।
এ ছাড়া, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং ওই মামলার এজহারনামীয় আসামি হওয়ায় বেরোবির গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ মন্ডলসহ সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯তম সিন্ডিকেট সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জুলাই বিপ্লবে শহীদ আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ৭১ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
গত ৫ জানুয়ারি দুপুরে বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকাত আলী।
উপাচার্য বলেন, দুই সেমিস্টারের জন্য ৩৩ জন শিক্ষার্থী এবং এক সেমিস্টারের জন্য ২৩ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটি সাবেক ১৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ পুনর্বহালের দাবি
জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই শিক্ষার্থীরা জোর দাবি করে আসছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীর নাম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে। শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন। তবে আলোর মুখ দেখেনি তাদের দাবি।
শিক্ষার্থীরা জানান, রংপুরের মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল ছিল ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’। ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে শেখ হাসিনা নিজেকে প্রতিষ্ঠাতা দাবি করতে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামফলক ও নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) করেন। অথচ বেগম রোকেয়া সরকারি কলেজ নামে নগরীতে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত।
এ ছাড়া, বেগম রোকেয়ার নামে পায়রাবন্দে একটি সরকারি কলেজ, একটি হাইস্কুল ও নগরীতে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পুনর্বহাল এবং শেখ হাসিনার নামে প্রতিষ্ঠিত একটি হলের নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া হল করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।
যৌন হয়রানি ও নম্বর টেম্পারিং
বছরজুড়ে বেরোবির দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘিরে উত্তাল ছিল বেরোবি। যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া নারীর সঙ্গে অভিযুক্তের ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। যৌন নিপীড়ন ও নম্বর টেম্পারিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তানজিউল ইসলাম জীবন এবং পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক রশিদুল ইসলামকে প্রশাসনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি এবং বরখাস্তের দাবিতে মশাল মিছিল এবং তাদের কুশপুত্তলিকায় জুতা মারারও কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
স্ট্রিট মেমোরি স্টাম্পে অসংগতি ও সমালোচনা
বেরোবির ১নং গেটের সামনে শহীদ আবু সাঈদ স্মরণে স্থাপিত করা হয় ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পে’। এতে জন্মতারিখসহ তথ্যগত নানা অসংগতি ধরা পড়ে। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর লাল কাপড় দিয়ে সেটি ঢেকে দেন তার সহযোদ্ধা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৬ জুলাই শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকীতে আবু সাঈদ স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকের সামনে ‘স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প’ স্থাপন করা হয়। এটি বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (এলজিইডি)।
স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পে লেখা হয়েছিল, ‘রংপুরের ছেলে শহীদ আবু সাঈদ। জালেম ও জুলুমের বিরুদ্ধে যার শির ছিল চির উন্নত। তিনি বলতেন, “প্রয়োজনে শহীদ হব, তবু মাথা নত করব না”। ১৬ জুলাই আসমানের দিকে দুই হাত প্রসারিত করে শাহাদাত বরণ করলেন। এরপরই সারা বাংলাদেশ জেগে ওঠে অনন্ত বিপ্লবের ওয়াদা নিয়ে।’
তবে পরবর্তীতে নানান আলোচনা-সমালোচনার পর স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্পটি সংশোধন শেষে নতুনভাবে উন্মুক্ত করা হয়। নতুন লেখা সংযোজন শেষে গত ১ অক্টোবর দিবাগত রাতে এটি পুনরায় উন্মুক্ত করা হয়।
বর্তমানে স্ট্যাম্পে লেখা রয়েছে, ‘বেরোবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ মিয়া। পিতা মো. মকবুল হোসেন, মাতা মোছা. মনোয়ারা বেগম। ১৬ জুলাই ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটের সামনে বুক চিতিয়ে, দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে গেলে পুলিশের নির্মম গুলিতে শহীদ হন। এরপর দেশজুড়ে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে, যা ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। তিনি বলতেন “বাঁচলে বাঁচার মতো বাঁচবো, কারো রক্তচক্ষুর ভয়ে ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পিছপা হবো না।”
প্রশাসনকে প্রতীকী শাড়ি-চুড়ি পরানো
নীতিমালা ভঙ্গ করে বেরোবিতে ছাত্র রাজনীতি করা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রতিবাদে গত ২০ জুলাই বিকেলে প্রশাসনকে শাড়ি ও চুড়ি দিয়ে নিন্দা জানাযন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর ছাত্র পরামর্শ উপদেষ্টা অধ্যাপক ইলিয়াস প্রামানিক ও প্রক্টর ড. ফেরদৌস রহমানের অনুপস্থিতিতে তাদের চেয়ারে শাড়ি জড়িয়ে দেওয়াসহ টেবিলে চুড়ি রেখে প্রতিবাদ জানায় তারা।
ছাত্র সংসদের দাবি ও আমরণ অনশন
বেরোবির আইনে ছাত্র সংসদ নির্বাচন যুক্ত করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন বিভিন্ন আন্দোলন সংবাদ সম্মেলনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আসছিলেন। দাবি না মানায় আমরন অনশনের সিদ্ধান্ত নেন তারা।
এরপর গত ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের উত্তর গেটে ৯ জন শিক্ষার্থী শুরু করেন আমরন অনশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা একাত্মতা পোষণ করে সব ধরনের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করার ঘটনাও ঘটে।
পরে উপাচার্য প্রফেসর ড. শওকাত আলী শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যুক্ত করা এবং নির্বাচনী রোড ম্যাপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তিন দিন পর ডাবের পানি পান করিয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান।
প্রথম সমাবর্তনের তারিখ ঘোষণা ও অতিথি বিতর্ক
সবশেষ গত ৭ অক্টোবর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. শওকাত আলী জানান, বেরোবির প্রথম সমাবর্তন আগামী ২০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। তবে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
এমন ঘোষণার পর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুরু হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের নানা মত ও প্রতিক্রিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তাই এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে অন্তত প্রধান উপদেষ্টা এবং তিনি একজন নোবেল বিজয়ী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকা উচিত।
fblsk
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা