উন্নয়নের নামে স্পর্শকাতর যায়গাগুলোকেই কেন বার বার বেছে নেয়া হচ্ছে? শুক্রবার (২২ নভেম্বর) বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাপা’র সভাপতি বিশিষ্ট মানবাধীকার কর্মী সুলতানা কামাল একথা বলেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র (সাগর-রুনি মিলনায়তন) সেগুণবাগিচায় “বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প-গুচ্ছ স্থাপনের পরিকল্পনাঃ ঝুঁকিতে বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী” -শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী সহ-সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে মুল প্রবন্ধ পাঠ করেন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল।
এতে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী ও বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক শারমীন মুরশিদ, বাপা কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চেীধুরী, মহেশখালী শাখার সদস্য সচিব আবু বকর সিদ্দিক প্রমূখ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক হুমায়ন কবির সমুন, অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, বাপা’র কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য যথাক্রমে ড. মাহবুব হোসেন, এম এস সিদ্দিকী, ইবনুল সাঈদ রানা প্রমূখ।
সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, বন, পাহাড় সমুদ্র সর্বপরি পরিবেশের মত স্পর্শকাতর যায়গাগুলোকে বিনষ্টের দিকেই সরকার এগুতে চাচ্ছে। উন্নয়নের নামে এ স্পর্শকাতর যায়গাগুলোকেই কেন বার বার বেছে নেয়া হচ্ছে? আমরা কখনও উন্নয়নের বিমুখ নই, কিন্তু সে উন্নয়ন হতে হবে সুপরিকল্পিত এবং পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি না করে বৃহত্তর জনগনের স্বার্থে। আমরা এ দেশটাকে বিশ্বেরর সবচেয়ে বেশী দূষণের দেশ হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা কক্সবাজার এবং মহেশখালীকে বাঁচাতে চাই।
ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, আমরা বৈজ্ঞানিক তথ্য নির্ভর বক্তব্য প্রদান করি। একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বিশ্বের এমন সব দেশের অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে কয়লা ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি বাপা এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে উপস্থাপন করেছে। তা সত্ত্বেও দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে দেশের পরিবেশকে ধ্বংস করছে যা বর্তমান সভ্যতায় মেনে নেওয়া যায় না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বর্তমান অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে কথা গুলো বলছি দেয়ালের সাথে, আর সেই দেয়ালটি হচ্ছে সরকার। সরকার তার অবস্থানে অনড় আর দেশবাসী তাদেও সাংবিধানিক অধিকার থেকে প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছে। চীন, জাপান এবং ভারত তাদের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকারকে পরিবেশ বিধংসী এ প্রকল্পগুলো এদেশে করতে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার এবং ইনভেস্টরদের মধ্যে একটা বিরাট সিন্ডিকেট চক্র তাদের ব্যবসায়ীক স্বার্থে এ প্রকল্পগুলো করছে। আমরা এ ধরণের উন্নয়ন চাই না যেটা একটা দোযখে পরিণত হবে।
শরীফ জামিল তাঁর লিখিত বক্তবে বলেন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ২৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৭ হাজার ৯৪৪ মেগাওয়াট (মে.ও.) বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম ১৭টি প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আজ মানুষ, পারিপার্শ্বিক জীববৈচিত্র্য,সামুদ্রিক অভয়ারণ্য, পাহাড়ি বনাঞ্চল, ভূ-প্রকৃতি, সমুদ্রসৈকত এবং বিস্তৃত কৃষিজমির জন্য হুমকিস্বরূপ প্রতীয়মান। পর্যটন নগরী কক্সবাজারের মূল শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে উল্লেখিত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন সবকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামি ১০ বছরে যদি সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয় তবে ৪০ বছরের স্থায়ীত্বকালে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র যে দূষণ তৈরি করবে তাতে এই অঞ্চলের বাসিন্দা ও প্রাণিকূল চরম বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে এবং বন ও সমুদ্রের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য অপূরণীয় স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
পরিকল্পিত ১৭ টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্রগুলো থেকে আনুমানিক ৭২ মিলিয়ন টন কার্বন-ডাই অক্সাইড, কয়েক হাজার টন কয়লা জাত ছাই, বিষাক্ত পারদ, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ইত্যাদি নির্গত হবার পাশাপাশি অন্যান্য ধাতব ও রাসায়নিক দূষণ ঘটবে। এর ফলে এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের মারত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। দূষণের কারণে দেশের প্রধান পর্যটন অঞ্চলক ক্সবাজারের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়বে।
শারমীন মুরশিদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ বিভিন্ন চুক্তির সাথে জড়িত, প্যারিস চুক্তি, এসডিজি সহ অনেক চুক্তিতে। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প যদি এভাবে চলতে থাকে তা হলে এ সমস্ত চুক্তি কি ভাবে বাস্তবায়িত হবে? সরকার এ ধরণের প্রকল্প গ্রহণের আগে পরিবেশবাদীদের এর ফলাফল কি হবে তা নিয়ে সাথে পরামর্শ করা উচিৎ ছিল।
বাপা কক্সবাজার শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চেীধুরী বলেন, কক্সবাজারের স্থানীয় লোকেদের রোজগার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। সরকার জমি অধিগ্রহণের ফলে যাদের জমি পড়েছে সে প্রকল্পে তাদেরকে অধিগ্রহণের টাকা নিতে দিনের পর দিন ধরনা দিতে হচ্ছে, তাও আবার একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ পার্সেন্টেজ ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। দিনমজুর কৃষক ও মৎস্যজীবীদের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ।
বাপা মহেশখালী শাখার সদস্য সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, যে উন্নয়নে সুফলের চেয়ে কুফল বেশী সে উন্নয়ন আমরা চাই না। আমরা স্থানীয় জনগন বুঝতেছি সেখানে কি উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে যারা শিল্পপতি তাদের, কিন্তু সেখানকার দিনমজুরদেও কোন উন্নতি নাই। তারা আজ সেখানে বাস্তু হারা, কর্ম হারা হয়ে দূর্ষহ জীবন যাপন করছে। সেখানে যে প্রকল্পের কাজ হচ্ছে সেখানে তারা আমাদের স্থানীয় শ্রমিকদের কাজপর্যন্ত দেয়নি। ফলে সেখানকার শ্রমজীবীরা অনাহারা ও অর্ধাহারে কালাতিপাত করছে।
তিনি আরো বলেন, যাদেও জমি সেই প্রকল্পের আন্ডারে পড়েছে তাদেরকে অধিগ্রহনের টাকা নিতে গেলে কাগজ পত্রের আকার-একারের ভুল ধরে টাকা দিতে চায় না অর্থচ পরে তারা ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত টাকা দাবী করে সেই পরিমাণ টাকা দিলে পরেই আগের কাগজেই টাকা দিয়ে দেয়।
শরীফ জামিল লিখিত বক্তবে আরো বলেন, তথ্যানুসন্ধানী একটি দল পর্যায়ক্রমে ২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ সালের ১৪ অগাস্ট এবং ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিলক ক্সবাজার, সোনাদিয়া, মহেশখালী, মাতারবাড়ি, পেকুয়া এবং বাঁশখালী অঞ্চল পরিদর্শন করে। তথ্যাঅনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তথ্যানুসন্ধানী দলের সদস্যরা স্থানীয় বাসিন্দা ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন।
তারা বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র্রস্থল, বৃহৎ আকারের শিল্প ও স্থাপনা পরিদর্শন করেছেন। অনুসন্ধানীদল প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্তচিত্র, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও তথ্য, সরকারি প্রতিবেদন যার মধ্যে রয়েছে অতিসম্প্রতি সংশোধিত পিএসএমপি ২০১৬, একটি পরিবেশগত প্রভাবমূল্যায়ন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে প্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে গবেষণা চালানোর পর দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশের জন্য আজকের এই সংবাদ সম্মেলনে আমরা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছি।
আরও পড়ুন : পিঁয়াজ, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কারসাজির সিন্ডিকেটের হোতাদের গ্রেপ্তার ও বিচার করার দাবি
সিংহভাগ বিদেশী অর্থায়নে বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনায় ইতোপূর্বে প্রকাশ করা হয়নি এমন তথ্য উঠে এসেছে গবেষণায়। এই গবেষণার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে জমি অধিগ্রহণ এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর নির্মাণের কারণে পরিবেশের কী ভয়াবহ বিপর্যয় সাধিত হবে এবং এ জন্য কতটা চড়া মূল্য দিতে হবে সেই তথ্য উদঘাটন ও প্রকাশ করা।
আজ এখানে যে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হল সেখানে দেখানো হয়েছে যে, এর পরিবেশগত প্রভাব কতটা গুরুতর হতে পারে। বাপা এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং এর মতো বড় আকারের পরিকাঠামো নির্মাণের আগে অবিলম্বে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) ও পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করার দাবি জানাচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো সেকেলে প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ওপর প্রকৃত প্রভাব কী হবে এবং এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে সেটা সমীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব হবে। পাশাপাশি আমরা নিরাপদ, নির্মল এবং বৈশ্বিক ভাবে গ্রহণযোগ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দাবি জানাচ্ছি।
আমরা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদুুৎকেন্দ্র সহ যে কোনো ধরনের বৃহৎশিল্প ও অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণের আগে ব্যাপক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা (এসইএ) ও গ্রহণযোগ্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করার দাবি জানাচ্ছি।
প্রথমে আমাদেরকে এটা ঠিক করতে হবে যে, এই অঞ্চলে আমরা কতটুকু শিল্পায়ন হতে দেব, তার পর সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে সবুজ শক্তির যোগান দিতে হবে যাতে করে আমরা সেখানকার পর্যটন, লবণ ও মৎস্যসম্পদ সহ সকল প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পারি।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা