বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত বছর যে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাশ হয়েছিল – তার বাস্তবায়ন কয়েক দফা পিছিয়ে যাওয়ার পর রোববার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।
কবে থেকে এটি কার্যকর হবে সেটিও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, তারা নতুন সড়ক পরিবহন আইন মানেন না।
অন্যদিকে মালিকরা বলছেন, তারা আইনটি কার্যকর করার আগে আরও সময় চান। কী কারণে এটি কার্যকর করতে এত সময় লাগছে?
যা বলছেন চালকেরা
বাংলাদেশে রোববার থেকে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পুরোপুরি প্রয়োগ হবার কথা ঘোষণা করেছিলেন পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সকাল থেকে ঢাকার রাস্তায় গণ-পরিবহনের সংখ্যা কিছুটা কমও ছিল। তবে আইনটি প্রয়োগের তেমন কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
লিটন শেখ নামে একজন বাসচালক বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে তারা গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেবেন।
তিনি বলছেন, “যেভাবে আইন করেছে এই অবস্থায় গাড়ি চালানো যাবে না। কারণ রাস্তার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কারণ রিক্সা, অটো নিয়মমাফিক চলে না। শুধু শুধু আমাদের নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে”
চালকদের যত জনের সাথে কথা হয় – তাদের সবারই আপত্তি একটি জায়গায়।
নতুন আইনে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও পাঁচ বছরের সাজার ব্যবস্থা রাখা রয়েছে। চালকরা অপরাধ বারবার করলে কঠোর বিধিগুলো আরোপ হবে।
ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা, নির্ধারিত গতি সীমার অতিরিক্ত গতিতে বা ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু হলে সেক্ষেত্রে আইনটিতে দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।
এসব ধারায় পরিবর্তন চান চালকেরা। বেশ ক্ষুব্ধভাবে সেটাই বলছিলেন আরেক বাস চালক রাজু আহমেদ।
তিনি বলছেন, “আমার পক্ষে সম্ভব পাঁচ লাখ টাকা দেয়া? এই যে ধরেন গুলি করে মারে, ড্যাগার দিয়ে মারে সেগুলোর কোন বিচার হয় না। কিন্তু আমি অ্যাকসিডেন্ট করলাম সেজন্য ৩০২ ধারা। মানে মার্ডার।”
তিনি আরও বলছেন, “এই আইন কার্যকর হলে সারা বাংলাদেশের গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়া দরকার।”
চালকদের বক্তব্য – তারা সাবধান হয়েই গাড়ি চালান, কিন্তু যাত্রীদের যতটা সচেতন হওয়া দরকার সে ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেই।” মালিকদের আপত্তি যা নিয়ে
কিন্তু নতুন আইনটি প্রয়োগ হচ্ছে কিনা বা কবে থেকে হবে – তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নিশ্চিত করে কোন কিছু বলতে পারেনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ থেকে বলা হয়েছে তারা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আদেশের অপেক্ষা করছেন।
মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নতুন আইনে অনেক অসামঞ্জস্য রয়েছে।
তাদের পক্ষ থেকে এটি কার্যকর করার ব্যাপারে আরও সময় চাওয়া হচ্ছে।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলছেন, “আইন যেটা সরকার চাচ্ছে সেটা কার্যকর হবে। কিন্তু কিছু কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে। সেগুলো সমাধান করতে হবে। আইনের বিধিটা করা উচিৎ।”
“বিধি করার আগে আইন প্রয়োগ করলে তাতে জটিলতা হবে।”
তিনি আরও বলছেন, “আইন প্রয়োগ নিয়ে আমাদের কোন দাবি নেই তবে আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম সময়টা বাড়ানোর জন্য। এখন সবাই বিআরটিএ-তে লাইন দিচ্ছে লাইসেন্স বা ফিটনেস করানোর জন্য। অনেক ভিড় সেখানে।”
“আইন সম্মান করেই হোক আর যে কারণেই হোক সবাই যাচ্ছে। সেই সময়টুকু তাদের দেয়া দরকার।”
তিনি বলছেন, গণ-পরিবহনের সংখ্যা দেশে পাঁচ লাখের মতো কিন্তু দেশে প্রাইভেট কার সহ নানা ধরনের গাড়ির সংখ্যা ৪০ লাখের উপরে। কিন্তু তাদের উপরেই চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বেশি।
আইনের সঠিক প্রয়োগ নিয়ে সন্দেহ
চট্টগ্রামের একজন শিক্ষক ইশরাত জাহান ঢাকার মহাখালী বাস স্ট্যান্ডের কাছে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
তিনি আইনটির সঠিক বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলছেন, “আইন সম্পর্কে এখনো শুনছি, এর আগেও শুনেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে প্রয়োগ কতটা হবে। আইনতো আগেও ছিল। সেটাওতো প্রয়োগ হয়নি। তারা কি আগেও কখনো আইন মেনে গাড়ি চালিয়েছে?”
বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা হয়েছে বহুবার, কিন্তু সবসময়ই সেটি ব্যর্থ হয়েছে।
গত বছর ঢাকায় বাস চাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ঢাকা জুড়ে সপ্তাহখানেক ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের যে নজিরবিহীন আন্দোলন হয় – তারই পটভূমিতে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাশ হয়।
একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী মোহসিনা আক্তার বলছেন, “নতুন কিছু শুরু হতে সময় লাগে। সবাই কোন কিছু প্রথম দিকে গ্রহণ করতে চায় না। সেটা বাস্তবায়ন করাটাও গুরুত্ব হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই সেনসিটাইজ করার জন্য একটু সময় দরকার।”
আইনটি পাশ হওয়ার পর থেকেই মালিক শ্রমিকরা এর কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি করে আসছেন।
গত বছর আগস্টে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। অক্টোবরে জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে।
পাশ হওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় পর পয়লা নভেম্বর থেকে সেটি কাগজেকলমে কার্যকর হয়েছে।
কিন্তু কিছুটা সময় দেয়ার জন্য এর প্রয়োগ শুরুতেই কয়েক দফা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের নিরাপদ সড়ক বিভাগের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী বলছেন, “সব পক্ষের সাথে কথা বলেই এই আইন পাশ হয়েছে। মালিকের সাথে, শ্রমিকের সাথে কথা বলেই আইন হয়েছে। সরকার একা তো আইন পাশ করেনি।”
কিন্তু কবে এটি প্রয়োগ শুরু হবে সেনিয়ে তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার ২০১৮ সালের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশে বছরে ২৪ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
অন্যদিকে পুলিশের তথ্য বলছে পাঁচ হাজারের বেশি।
সংখ্যায় পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন খাত যে দেশের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল খাতগুলোর একটি – সেটি মানবেন অনেকেই। বিবিসি বাংলা।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা