বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে। সোমবার (১৮ নভেম্বর) শিশু অধিকারের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইউনিসেফ এই তথ্য জানিয়েছে।
ইউনিসেফ বলেছে, ঐতিহাসিক প্রাপ্তি ও অনস্বীকার্য অর্জন, তবে বিশ্বের দরিদ্রতম শিশুদের জন্য অগ্রগতি সামান্য।৩০ বছর আগে শিশুদের অধিকার বিষয়ক কনভেনশন গৃহীত হওয়ার পর থেকে বিশ্বের শিশুদের জন্য সার্বিকভাবে ঐতিহাসিক অর্জন রয়েছে।
তবে সোমবার প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদন দ্য কনভেনশন অনদ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড অ্যাট এ ক্রসরোডস-অনুসারে, দরিদ্রতম শিশুদের অনেকের ওপরই এটি এখনও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।
সিআরসি গৃহীত হওয়ার ৩০তম বার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে প্রতিবেদনে গত তিন দশকের অনস্বীকার্য অর্জনগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে । যা প্রমাণ করে–রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থাকলে শিশুদের জীবনমানের উন্নতি হবেই ।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, গত তিন দশকে শিশুদের জন্য দারুণ কিছু অর্জন রয়েছে, কারণ এখন অনেক বেশি সংখ্যক শিশু দীর্ঘ, উন্নত ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করছে । তবে, দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের বেলায় এখনও অনেক প্রতিকূলতা রয়ে গেছে ।
স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আজকের শিশুদের জলবায়ু পরিবর্তন, অনলাইনে নিগ্রহ ও সাইবার উৎপীড়নের মতো নতুন নতুন হুমকি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কেবলমাত্র উদ্ভাবন, নতুন প্রযুক্তি ।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও বর্ধিত সম্পদই সর্বত্র সব শিশুর জন্য শিশু অধিকার বিষয়ক কনভেনশনের লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপদান করতে সহায়তা করবে। গত তিন দশকে শিশু অধিকার বিষয়ে নানা অগ্রগতির কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রায় ৬০ শতাংশ কমেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সী শিশুদের বিদ্যালয়ে না যাওয়ার অনুপাত ১৮ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বৈষম্যহীনতা; শিশুর স্বার্থকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া; বেঁচে থাকা ও ভালোভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার; এবং সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার–সিআরসি’র এই মূল নির্দেশিকা সমূহ বিশ্বব্যাপী অসংখ্য সংবিধান, আইন, নীতিমালা ও অনুশীলনকে প্রভাবিত করেছে। তবে এই অগ্রগতি সর্বত্র সমানভাবে হয়নি বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে দরিদ্রতম পরিবারের শিশুদের পঞ্চম জন্মদিনের আগেই প্রতিরোধযোগ্য কারণে মৃত্যুর সম্ভাবনা ধনী পরিবারের শিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ।
সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ধনী পরিবারের ৮৫ শতাংশ শিশুকেই যেখানে হামের টিকা দেওয়া হয়, সেখানে দরিদ্রতম পরিবারগুলোর শিশুদের মাত্র অর্ধেক এই টিকা পায়।
বৈশ্বিকভাবে শিশুবিয়ের হার কমে যাওয়া সত্ত্বেও কিছুদেশের দরিদ্রতম মেয়েরা ১৯৮৯ সালের তুলনায় বর্তমানে অনেকবেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর দীর্ঘদিনের পুরনো এবং নতুন নতুন হুমকির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং প্রান্তিকীকরণের কারণে এখনও সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত লাখ লাখ শিশুর ঝুঁকির মুখে থাকা অব্যাহত রয়েছে: সশস্ত্র সংঘাত, ক্রমবর্ধমান বর্ণবিদ্বেষ এবং বিশ্বব্যাপী অভিবাসন ও শরণার্থীসংকট–সবকিছুই বৈশ্বিক অগ্রগতিতে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
জলবায়ু সংকটজনিত কারণে শিশুরাই শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয়ভাবে এবং রোগে আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে: জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন রোগ ছড়াচ্ছে, চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনার তীব্রতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি করছে এবং খাদ্য ও পানির নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে অনেক শিশুকে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হতে পারে।
আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় টিকা দেওয়া শিশুর সংখ্যা এখন অনেক বেশি হলেও গত দশকে টিকাদান কর্মসূচির আওতাবৃদ্ধির ধীরগতি শিশু স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কঠিন অর্জনকে উল্টে দেওয়ার হুমকি তৈরি করেছে: ২০১০ সাল থেকে হামের টিকা দানের আওতা প্রায় একই জায়গায় রয়ে গেছে।যা অনেক দেশে প্রাণঘাতী এইরোগের পুনরুত্থানে ভূমিকা রাখছে।
২০১৮ সালে হামে আক্রান্ত হওয়ার প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা ২০১৭ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা শিশুদের সংখ্যা একটা জায়গায় আটকে গেছে এবং স্কুলগামী শিশুদেরক্ষেত্রেও শেখার ফলাফল অত্যন্ত নিম্নমানের রয়ে গেছে: বৈশ্বিকভাবে, শিক্ষার প্রাথমিকস্তরে না থাকা শিশুদের সংখ্যা ২০০৭ সাল থেকে স্থির হয়ে আছে। যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের অনেকেই মৌলিক বিষয়গুলো শিখছেনা। এছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও তারা অর্জন করতে পারছে না।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশে আরব আমিরাতের আরও বড় আকারের বিনিয়োগের প্রত্যাশা
শিশু অধিকার সমূহের অগ্রগতিকে জোরদার করার জন্য এবং এই অধিকারসমূহের কয়েকটির থমকে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়ার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করতে প্রতিবেদনে আরও তথ্য ও প্রমাণ সংগ্রহ করার; প্রমাণিত সমাধান জোরদার করার; সম্পদের জোগান বাড়ানোর; যৌথভাবে সমাধান বের করতে তরুণদের সম্পৃক্ত করার; এবং কর্মসূচি প্রণয়নে ন্যায্যতা ও লিঙ্গসমতার নীতি প্রয়োগ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে এটাও স্বীকার করা হয়েছে যে, পরিবর্তন আনার জন্য এইসমস্ত উপাদানগুলো প্রয়োজনীয় হওয়াসত্ত্বেও আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে উদীয়মান সুযোগ ও চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করার জন্য এবং পুনরায় বৈশ্বিক কারণ হিসেবে সত্যিকার অর্থে শিশু অধিকারকে সন্নিবেশিত করার জন্যও নতুন পদ্ধতির প্রয়োজন।
এই উপায়গুলো খুঁজে বের করার জন্য আগামী ১২ মাসের মধ্যে ইউনিসেফ একটি বৈশ্বিক সংলাপের আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছে যাতে প্রতিটি শিশুর জন্য কনভেনশনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পরিণত করতে কী করা প্রয়োজন তা জানা যায়। এই আলোচনা হবে অংশগ্রহণমূলক, যেখানে শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠী, বাবা-মা ও শিশু প্রতিপালন কারী, শিক্ষা ও সমাজকর্মী, কমিউনিটি ও সরকার, সুশীল সমাজ, একাডেমিয়া, বেসরকারিখাত ও গণমাধ্যমের সম্পৃক্ততা থাকবে এবং এটি সংস্থাটির ভবিষ্যৎ কার্যক্রমকে প্রভাবিত করবে।
ফোর বলেন, কনভেনশনটি এর উজ্জ্বল অতীত এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মাঝখানে একটি সংযোগস্থলে অবস্থান করছে । পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া, সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং নিজেদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো আমাদের ওপরই নির্ভর করছে।
এমন তরুণদের কাছ থেকে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করা উচিত যারা তাদের অধিকারের জন্য কথা বলছে,যা তারা আগে কখনও বলেনি এবং আমাদের অবশ্যই সাহস ও সৃজনশীলতার সঙ্গে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
ফেসবুক পেজ :
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা