পেঁয়াজ, শুনলেই মনে হয় ঝলসে যাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মতো অনেকেরই এখন পেঁয়াজের কথা শুনলে এমনটাই মনে হচ্ছে। কারণ, বাঙালির খাদ্য তালিকার একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান এই পেঁয়াজের অত্যধিক চড়া বাজার মূল্য। পরিমাণের দিক দিয়ে পেঁয়াজ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মসলা। তবে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা এবং সব্জিও বটে। সেই পেঁয়াজের ঝাঁজে পুড়ছে সাধারণের পকেট। এখন পেঁয়াজ খাওয়াটা মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য গরীবের ঘোড়া রোগের মতো দাঁড়িয়েছে। গত মাস দুয়েক ধরে পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে উচ্চবিত্ত ছাড়া প্রায় সব শ্রেণির মানুষেরই রুদ্ধশ্বাসে চলছে জীবন। তাদের প্রশ্ন, এক পেঁয়াজেই যদি কেজি প্রতি ১২০ থেকে দেড়শ’ টাকা গুণতে হয়, তাহলে বাকি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনবে কি দিয়ে?
হ্যাঁ, এটা সত্যি, গত এক দশকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু কাজীর গরু যদি গোয়ালে না থেকে, শুধু কিতাবে থাকলে তো লাভ নেই। কাগজ-কলমের হিসাবের সাথে সাধারণের জীবনের হিসাব তো মেলে না। একটা শ্রেণির হাতে টাকা বেড়েছে। গত দশ বছরে সরকারী কর্মকর্তাদের কয়েক দফা বেতন-ভাতা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। ধনিক ব্যবসায়ি পরিবারের কথা না হয় বাদ রাখা গেল। কিন্তু ব্যবসায়ি বা বেসরকারি চাকরিজীবী যার কথাই বলুননা কেন, যারা স্বল্প আয়ের মানুষের তালিকায় পড়েন, তাদের সংখ্যাই তো এই দেশে বেশি। ফলে তাদেরকেই তো ধর্তব্যে নিয়ে কর্মপন্থা তৈরি করতে হয়, তাই নয় কি! হিসেবে তো সংখ্যাগরিষ্ঠরাই প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তা হচ্ছে?
কথা হচ্ছিল পেঁয়াজের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। আমাদের দেশে চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে যদিও পেঁয়াজের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাপি আমদানির পরিমাণও বাড়ছে। রমজান মাসে ও কোরবানি ঈদের সময় পেঁয়াজের চাহিদা দ্বিগুণ/তিনগুণ হয়ে যায়। বিশেষ করে রমজান মাসে পেঁয়াজের ব্যবহার অনেক বেশি বেড়ে যায়। সেই অজুহাতেও ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দর এক/দুই দফা বাড়িয়ে দেন, যা চলতে থাকে কুরবানীর ঈদের পরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু এ বছরের মতো এতোটা অস্থির বাজার দেখা যায়নি স্মরণকালে। আগস্টের শেষ দিকে প্রায় হঠাৎই অস্থিরতা দেখা দেয় পাইকারি ও খুচরা পেঁয়াজের বাজারে। ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা এর জন্য ভারতীয় পেঁয়াজের বাজারকে দায়ী করেন। কয়েকদিন আগে ভারত রপ্তানির সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে- ফলে পরদিনই বাংলাদেশের বাজারে দাম বেড়ে যায়। তখন থেকেই সরকার বলছে, পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ আছে, আতঙ্কের কিছু নেই।
মোটা দাগে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টনের কিছু বেশি। পেঁয়াজ উৎপাদনের জরিপকারী সরকারের দুই সংস্থা- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই, পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে দুই রকম হিসাব দিচ্ছে। এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার উৎপাদনের তথ্যে ফারাকও প্রায় পাঁচ লাখ টনের বেশি। ডিএই’এর হিসাবে, ২০১৮–১৯ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন। অন্যদিকে, বিবিএস বলছে, পেঁয়াজের উৎপাদন ১৮ লাখ ৩ হাজার টন। পেঁয়াজ উৎপাদনের এই ‘বিভ্রান্তিকর’ পরিসংখ্যান নিয়েই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। মানুষের আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হলো, যদি ঘাটতি না থাকে তাহলে বাজার মূল্য জনসাধারণের হাতের নাগালে থাকছে না কেন?
আমি অর্থনীতি বুঝিই না, কিন্তু এটুকুন বুঝি যে, চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে বাজারে কোন পণ্যের ঘাটতি হয় না। ফলে চড়ামূল্যের প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু সম্প্রতি ঝড়ো গতিতে পেঁয়াজের দর সেই যে শতক ছাড়িয়েছে আর নামছে না। সরকারও ব্যবস্থা নিচ্ছে না যে তা নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য উচ্চপর্যায়ের ১০জন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে। তাঁরা বিভিন্ন জেলার বাজারে তদারকি শুরু করেছেন। বন্দরে পেঁয়াজ খালাস দ্রুত করতে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও পেঁয়াজের ঝাঁজ কমাতে অভিযানও চলেছে। কোথাও কোথাও জরিমানা করা হয়েছে, সিলগালা করা হয়েছে গুদাম। কিন্তু কোন কিছুই কাজ করছে না কেন, এর উত্তর নেই কোথাও।
দেশের বেশ কয়েকটি বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে দু’একদিন দাম বেশ কিছুটা কমলেও ফল পায় না খুচরা ক্রেতারা। তবে ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত করছেন এই বলে যে, আগামী ডিসেম্বরেই দেশে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। আবার অন্যান্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। ফলে পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে। তার মানে কি, এ ক’দিন ব্যবসায়ীদের যে, যেভাবে পারছেন সেভাবেই পেঁয়াজ বিক্রি করবেন? বাজার দর কমাতে পারলেও কমাবেন না!! যারা অন্যতম প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান এই পেঁয়াজের দর যাদের নিয়ন্ত্রণে সেই সংশ্লিষ্টদের কানে কি পৌঁছবে এই বার্তা- মুনাফা ব্যবসারই অংশ, কিন্তু সেটা যেন সাধারণের গলার ফাঁস না হয়ে দাঁড়ায়, এটা খেয়াল করাও ব্যবসার নীতি ও ধর্ম।
নাসরীন গীতি সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা