দরিদ্ররা যে দরিদ্র্য, তার কারণ শুধু এই নয় যে তাদের টাকা নেই। আরো নানাবিধ অভাবের কারণে তারা দরিদ্র: যেমন, অনেক মৌলিক বিষয়ে সম্যক জ্ঞান, আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং নিজেদের সক্ষমতার উপর আস্থার অভাব। এ কারণেরই, ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির (সংক্ষেপে এমআইটি) অর্থনীতির অধ্যাপক অভিজিৎ ব্যনার্জী এবং এসথার ডুফলো তাদের ২০০৪ সালে প্রকাশিত বই “পুয়োর ইকোনমিক্স”-এ বলেছেন, দরিদ্রদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শুধু দক্ষতা, ইচ্ছাশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ালেই হবে না, প্রয়োজন আরও বেশি কিছু। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে অতি দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়াটা কেন খুব সোজা কাজ নয়। অতি দরিদ্র বলতে তাদের বোঝানো হয় যারা দৈনিক ১.২৫ ডলার (২০১৯-এর বিনিময় হার অনুযায়ি প্রায় ১০৬ টাকা) এর কম আয় করেন।
দারিদ্র্য বিমোচনে যতরকম কর্মসূচি দুনিয়ায় আছে, তাতে দেখা গেছে কেবল অল্প কিছু এলাকার, অল্প কিছু মানুষ, অল্প কিছু সময়ের জন্যই উপকৃত হয়। মূল সমস্যাটা হলো, এসব কর্মসূচিতে যারা অংশগ্রহণ করে, শুরুতে তাদের অনেকেই দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেই অবস্থাটা তারা ধরে রাখতে পারে না। বেশিরভাগই কিছুদিন পরে আবার আগের অবস্থায় ফেরত যায়। যেমন ধরা যাক ক্ষুদ্রঋণের কথা। এ ধরণের ঋণ নিয়ে শুধুমাত্র তারাই উন্নতি করতে পারে যারা ব্যক্তি হিসেবে উদ্যোগী প্রকৃতির। অতি দরিদ্রদের মধ্যে আবার এ ধরণের উদ্যোগী মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি না। একইভাবে, শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ বা এ ধরণের প্রকল্পের সাফল্যের জন্য প্রয়োজন কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা। এক দেশে যেটা কাজ করেছে, অন্য দেশে আবার সেটা করেনি। এর মূল কারণ সংস্কৃতি ও পারিপার্শ্বিকতায় ভিন্নতা। এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সবচেয়ে দরিদ্র যারা, তাদের অবস্থায় পরিবর্তন আনাটাই সবেচেয়ে কঠিন।
সুতরাং, পুরো ছবিটা দেখে আশাহত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এই বাস্তবতায়, অধ্যাপক ব্যনার্জী, অধ্যাপক ডুফলো এবং আরো কয়েকজনের লেখা অন্য আরেকটি নিবন্ধের বিষয়বস্তুকে চমকপ্রদ মনে হতে বাধ্য। তাঁদের দাবি, দারিদ্র্য দূরীকরণের এমন একটি কৌশল তাঁরা বের করেছেন যা সব জায়গায়, সব ধরণের মানুষের জন্য কাজ করবে। গবেষণাটি করা হয়েছে সাত বছর ধরে, বিশ্বের ৬টি দেশের প্রায় ১০ হাজার দরিদ্র পরিবারের উপর। এই কৌশলের অংশ হিসেবে, ওই পরিবারগুলোকে প্রথমে কিছু সম্পদ (মূলত গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগী) হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাদের দেয়া হয় কিছু নগদ অর্থ সহায়তা। সবেশেষে দুবছর ধরে তাদের নানারকম প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দেয়া হয় যাতে তারা সেই সম্পদগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে। ঘানা, পাকিস্তান ও পেরুর মতো কয়েকটি দেশে দেখা গেছে যে এই ফর্মুলায় একেবারে হতদরিদ্র মানুষের জীবনে একটা দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
অতি দারিদ্র্য দূর করার এই কৌশলটির মূল প্রবক্তা বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটি এর নাম দিয়েছে “গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম”। আগেই বলা হয়েছে যে দরিদ্র মানুষেরা নানাবিধ সমস্যার কারণে এই অবস্থায় পতিত হন। তাই এই কৌশলটির পেছনে যুক্তিটা এরকম: একটি সমস্যা সমাধান করে, বাকি সমস্যাগুলোকে ফেলে রাখলে কোনও লাভ হবে না। যার শরীরে অনেকগুলো গভীর ক্ষত, তার মাত্র একটিতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বাকিগুলোকে ফেলে রাখলে সেগুলোতে পচন ধরবে এটাই স্বাভাবিক। যেমন ধরা যাক হিইফার ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফাম বা ওয়ার্ল্ড ভিশনের কথা। এই আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো অনেক উন্নয়নশীল দেশে দরিদ্রদের মাঝে গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগী বিতরণ করে যাতে তারা দুধ বা ডিম বিক্রি করে আয়-উন্নতি করতে পারে। কিন্তু যদি দরিদ্র মানুষগুলো ক্ষুধার জ্বালায় সেই গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগী খেয়ে ফেলে, তখন কি হবে?
ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামেও দরিদ্রদের হাঁস-মুরগী দেয়া হয়েছে। তবে সাথে দেয়া হয়েছে কিছু নগদ অর্থ সাহায্য যাতে তাদের প্রথমেই সেই হাঁস-মুরগী খেয়ে ফেলার প্রয়োজন না হয়। পাশাপাশি দেয়া হয়েছে হাঁস-মুরগী পালনের উপর প্রশিক্ষণও। এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা বারবার তাদের বাড়িতে গেছেন, নিয়মিত তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেছেন। এমআইটির গবেষক ব্যানার্জী, ডুফলো এবং তাদের সহযোগীরা, স্থানীয় এনজিওদের সাহায্যে এই মডেলটি নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন ইথিওপিয়া, ঘানা, হন্ডুরাস, ভারত, পাকিস্তান এবং পেরুতে। সব জায়গাতেই অতি দরিদ্রদের এই কর্মসূচির আওতায় আনা হয়। ভারতে যে পরিবারগুলো এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে, তাদের ৭৩% ছিলো অতি দরিদ্র। ইথিওপিয়ায় ছিলো ৬৬ শতাংশ। এদের সবার দৈনিক আয় ছিলো ১.২৫ ডলারের কম।
এই ৬টি জায়গাতেই দরিদ্র পরিবারগুলোকে যেকোনও একটি সম্পদ (গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগী) বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। এটা তাদের দেয়া হয় এককালীন অনুদান হিসেবে। পাশাপাশি, এক বছর ধরে প্রতিদিন এক কেজি চাল কেনার জন্য যে পরিমাণ টাকা প্রয়োজন, তাদের সেটাও দেয়া হয়। প্রদত্ব সম্পদ ব্যবহার করে কিভাবে আয়-রোজগার করা যায়, সে বিষয়ে তো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ই, পাশাপাশি কিভাবে এই প্রাণিগুলোকে সুস্থ রাখা যায় শেখানো হয় তা-ও। সবশেষে, আয়ের একটি অংশ কিভাবে নিরাপদে সঞ্চয় করা যায়, তাদের সেই উপায়ও বাতলে দেয়া হয়। আর নানাভাবে উৎসাহ দেয়ার বিষয়টি তো রয়েইছে। অবশ্য দেশভেদে কিছু কিছু ভিন্নতা ছিলো। যেমন কোনও কোনও দেশে দেয়া হয়েছে গরু-ছাগল, কোথাও বা হাঁস-মুরগী। অর্থ সঞ্চয়ের বিষয়টির ওপর কোনও দেশে বেশি জোর দেয়া হয়েছে, কোনও দেশে কম। তবে মূল কর্মকৌশলটা সবখানে একই ছিলো।
এই পরীক্ষার ফলাফল ছিলো আশাব্যাঞ্জক। কর্মসূচিগুলোর দুবছরের মেয়াদ শেষে দেখা গেছে, অন্যদের তুলনায় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর মাসিক খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ। তাদের পারিবারিক আয়ও বেড়েছে। রাতে খালিপেটে ঘুমোতে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে। সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ১৫%, যা দেখে বোঝা যায় যে তাদের যে হাঁস-মুরগী দেয়া হয়েছে সেগুলো তারা খেয়ে ফেলেনি। তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১৭ মিনিট বেশি কাজ করেছে, মূলত গবাদিপশু বা হাঁস-মুরগী প্রতিপালনে। এক্ষেত্রে যদিও কিছু কিছু দেশে ভিন্নতা আছে – যেমন হন্ডুরাস ও পেরুতে এই সময়টা তেমন একটা বাড়েনি, আবার ইথিওপিয়াতে বেড়েছে গড় থেকে বেশি হারে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি হলো: একদম দরিদ্রদের মধ্যেও যারা দরিদ্রতম (অর্থাৎ একেবারে নিচের দিকের ১০% পরিবার), তাদের পারিবারিক ব্যয় ও সম্পদের ব্যবহারের উপর একটা দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
এই গবেষকরা যখন কর্মসূচিগুলো শুরু হওয়ার এক বছর পর এই পরিবারগুলোর সদস্যদের সাথে গিয়ে কথা বলেছেন, দেখা গেছে তখনই তারা আগের চেয়ে বেশি সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করছেন, তারা আগের চেয়ে বেশি আয় করছেন এবং খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। গবেষকরা তখন বলেছেন যে কর্মসূচিগুলো আরেকটু লম্বা সময়ের জন্য চালু রাখা গেলে, বিনিয়োগের তুলনায় অন্তত ১.৩৩ থেকে ৪.৩৩ গুণ বেশি সুফল পাওয়া যেত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বাংলাদেশের কথা যেখানে এরকমই আরেকটি গবেষণায় টানা ৩ বছর ধরে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম হলো হন্ডুরাস। সেখানে কোনও একটা কারণে হাঁস-মুরগী মরে যাওয়ায় কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায়নি।
এই পরীক্ষামূলক কর্মসূচিগুলোর পরিচালনা ব্যয় দেখলে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে – যেমন ভারতে প্রতি পরিবারের পেছনে খরচ হয়েছে ৪১৪ ডলার এবং পেরুতে ৩,১২২ ডলার। তবে এর অন্য দিকটি হলো, অংশগ্রহণকারীদের যেসব সহায়তা দেয়া হয়েছে, সেগুলো সব এককালীন, যেখানে অন্য প্রায় সব দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসুচিতে অংশগ্রহণকারীরা আজীবন সহায়তা পেতেই থাকেন। সেই হিসেবে এই গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম অন্য কর্মসূচির তূলনায় কম ব্যয়বহুল। ভারতের কথাই ধরা যাক। দেশটি প্রতিবছর তাদের জিডিপির ০.৩% ব্যয় করে ৫ কোটি পরিবারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। এটা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। সে তুলনায়, একই সংখ্যক পরিবারের জন্য গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে ২ বছরের জন্য এককালীন ব্যয় হবে জিডিপির ১ শতাংশ।
কিছু কিছু পরিবর্তন এনে গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামটি আরো কম খরচে বাস্তবায়নেরও উপায় আছে। যেমন মাঠকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি। পুরো কর্মসূচির সবচেয়ে ব্যয়বহুল অংশ এটি – অংশগ্রহণকারীদের সম্পদ হস্তান্তরে তুলনায় এতে খরচ হয় দিগুণ । উগান্ডায় সম্প্রতি একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালানো হয়েছে। সেখানে মাঠকর্মীরা আরও ঘনঘন বাড়িবাড়ি গিয়ে পরিবারগুলোর সাথে দেখা করেছেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনও বাড়তি লাভ হয়নি। সুতরাং এখানে কিছু কাটছাটের সুযোগ আছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, দারিদ্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা এখন যেন আগের চেয়ে একটু কম অসম বলে মনে হচ্ছে।
( দারিদ্র্য দূরীকরণে অবদানের জন্য এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন এসথার ডুফলো, অভিজিৎ ব্যনার্জি এবংমাইকেল খ্রেমার। । ২০০৭ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ব্র্যাকের আল্ট্রা-পুয়োর গ্র্যাজুয়েশন মডেল নিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করেছিলেন এসথার ডুফলো এবং অভিজিৎ ব্যনার্জি। এই গবেষণার ফল প্রকাশ হওয়ার পরপরই বিশ্বজুড়ে ব্র্যাকের “আল্ট্রা পুয়োর গ্র্যাজুয়েশন” মডেল নিয়ে ব্যপক আলোচনা শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্র্যাক প্রণীত এই মডেলটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ২০১৫ সালে তাদের গবেষণার উপর একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিলো বিখ্যাত ব্রিটিশ সমায়িকী “দ্যা ইকোনমিস্ট”-এ। সেটির ভাবানুবাদ। )
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা