অবৈধ টাকা রাখার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতারা। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ায় এই দুর্নীতিবাজ নেতারা এখন বিপাকে পড়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে অনেকে বস্তায় ভরে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে, আত্মীয়স্বজনের কাছে। আর কেউ কেউ নিজেকে রক্ষা করতে টাকা নষ্ট করে ফেলে দিচ্ছেন। আবার টাকা রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের চার শতাধিক নেতাকর্মী। এছাড়া এই মুহূর্তে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন ছয় শতাধিক নেতাকর্মী। আবার অনেকে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
রাজনীতির নামে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, পেশিশক্তির প্রয়োগসহ যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই ধারাবাহিকতায় চলছে শুদ্ধি অভিযান।
গ্রেফতারকৃতরা অধিকাংশই ক্যাসিনো কারবার ও প্রভাব বিস্তার করে বড় ঠিকাদারি প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবারও রাজধানীর পুরান ঢাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতার আস্তানা থেকে কোটি কোটি টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার পাওয়া গেছে।
সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, চলমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানের পরিধি আরও বিস্তৃত হচ্ছে। অভিযানে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি করে যারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, ধরা পড়বেন তারাও।
সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির কথায় অভিযান অব্যাহত থাকবে, এমন আভাস পাওয়া গেছে। চলতি ‘ঝড়ের’ টার্গেট যে কেবল ছাত্রলীগ-যুবলীগে সীমিত থাকবে না, এটা নিশ্চিত করেছেন তারা।
মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ক্যাসিনোর সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কিছু আওয়ামী লীগ নেতা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগ চলতি মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাবে- এমন ঘোষণা দেয়। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এখন মাঠে যেটা হচ্ছে, তা সরকারের ওই প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের একটি দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারির পদ হারানো, যুবলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নজর রাখা হচ্ছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ ধরনের অভিযানের কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। যদিও বিএনপি বিষয়টি অন্যভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সূত্র বলছে, ছাত্রলীগ, যুবলীগের পর সরকারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ধরতে কী প্রক্রিয়ায় অভিযান চালানো যায়, তা নিয়ে এখন ভাবছেন নীতি নির্ধারকরা। এক্ষেত্রে শুধু দুদক নয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ব্যবহার করা হতে পারে। তবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ধরতে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে সীমিত রাখতে চাচ্ছে না।
সম্প্রতি দুদক বিভিন্ন সেক্টরের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। তবে এবারের শুদ্ধি অভিযান দুদকের মধ্যে সীমিত থাকবে না।
সরকারদলীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে তাদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। তাদের দুই ধরনের ভাষ্য উঠে এসেছে।
একপক্ষ বলছে, ‘শুদ্ধি’ অভিযান আরও আগে শুরু করা গেলে ভালো হতো। আরেক পক্ষ বলছে, বিলম্বে হলেও এ ধরনের অভিযানে সরকারের ইতিবাচক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল। যদিও চলমান অভিযানের শেষ পরিণতি নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ধরনের সংশয় কাজ করছে।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণকাজ যারা অনিয়মের মাধ্যমে বছরের পর বছর বাগিয়ে নিচ্ছিলেন, তাদের তালিকা তৈরি করা হবে। এরপর বের করা হবে, কাকে কীভাবে কমিশন দিয়ে তারা কাজ পেতেন, সে তথ্য। এরপর পাশাপাশি ‘হোয়াইট কালার’ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যাপারেও তথ্য নেওয়া হবে।
সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক নয়, শুদ্ধি অভিযানের পরিধি দেশের অন্যান্য এলাকায় বিস্তৃত করা হবে। সরকার এমন বার্তা দিতে চায়- দুর্নীতি আর অনিয়ম করলে কোনো ছাড় পাওয়া যাবে না। যত ক্ষমতাধরই হোক, অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তা ভেঙে দিতে চান নীতিনির্ধারকরা। জনমনে যাতে বিশ্বাস তৈরি হয়- দুর্নীতি করলে ছাড় পাওয়া যাবে না। সরকারের বর্তমান ও সাবেক কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন কি-না, তদন্ত হবে তা নিয়েও।
সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে, যদি প্রমাণ হয় কেউ বেআইনিভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জন করেছে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা হবে। এরপর জব্দ হবে তার সম্পদ।
সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। অভিযানের একপর্যায়ে টেকনাফে মাদক কারবারিদের সম্পদ ও বাড়ি জব্দ করা হয়। এবারের শুদ্ধি অভিযানে প্রয়োজনে দুর্নীতিবাজদের বাড়ি-গাড়ি জব্দ হবে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পরিচয় ব্যবহার করে যারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, খোঁজ নেওয়া হচ্ছে তাদের ব্যাপারে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, যুবলীগ নেতা জি কে শামীম গ্রেফতারের পর জানান, ৮-১০ শতাংশ কমিশন দিয়ে গণপূর্তের ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিতেন তিনি। গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল হাইকে দেড় হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন তিনি। শুধু গণপূর্ত বিভাগে নয়, সরকারের অন্যান্য দপ্তরেও যারা এমন কমিশনভোগী ছিলেন, তাদেরও চিহ্নিত করা হবে।
সূত্র বলছে, চলমান অভিযানে এরই মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরের দুর্নীতিবাজদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহভাজনদের বিদেশ যাত্রা ঠেকাতে নজর রাখছে। যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টার্গেটে রয়েছেন আরও অন্তত ২০ জন যুবলীগ নেতা। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ ভবনের ঠিকাদারিতে যারা অনৈতিক প্রভাব রাখতেন, তারাও আছেন নজরদারিতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যুবলীগের তিন নেতার বাড়িতে রয়েছে টাকা গোনার মেশিন। প্রতিদিন অনেক টাকা একসঙ্গে অল্পসময়ে গুনতে গুনতে ক্লান্ত ও বিরক্ত হওয়ারই কথা! এরপর আছে জাল নোটের ভয়। তাই যুবলীগের ঐ তিন নেতা ক্রয় করেন মানি কাউন্টিং অ্যান্ড নোট ডিটেক্টিং মেশিন, যা তাদের সময় ও পরিশ্রম বাঁচিয়ে দেয়। অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা, পদ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের মোটা অঙ্কের টাকা যেত ঐ তিন নেতার কাছে।
অভিযানের ফলে দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম করে দলের ইমেজ ক্ষুণ্নকারী নেতাকর্মীরা আছেন ‘দৌড়ের ওপর’। অভিযান থেকে বাদ পড়বেন না আমলারাও।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা