রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সবচেয়ে বেশি বাতাসে ধাতুর ঘনত্ব পেয়েছে গবেষক দল। তারা রাজধানীর ১০টি সংবেদনশীল এলাকায় চারবার ধাতুর মাত্রা মাপার পর এই তথ্য পায়। বাতাসে সবচেয়ে কম ধাতু রয়েছে উত্তরা এলাকায়।
রবিবার (১ মার্চ) “ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের বায়ু দূষণ সমীক্ষা-২০১৯ এর ফলাফল” প্রকাশ অনুষ্ঠানে গবেষকরা এতথ্য জানান।
গবেষক দল জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৪ মাইক্রোগ্রাম), ধানমন্ডি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৬ মাইক্রোগ্রাম) ও বাংলাদেশ সচিবালয় এলাকায় (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬০ মাইক্রোগ্রাম ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জানা যায়, বায়ুদূষণের দিক দিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের রাজধানী শহরগুলোর মধ্যে দূষণের দিক দিয়ে ২০১৮ সালের ন্যায় ২০১৯ সালেও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা শহর।
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার (আইকিউ এয়ার) থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর মাত্রা ছিল ৮৩ দশমিক ৩ মাইক্রোগ্রাম; যা আদর্শমান হতে প্রায় ৫ দশমিক ৫ গুন বেশী।
নগরীর দূষণ মানচিত্রের আংশিক চিত্র।
পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুতে বস্তুকণা ২.৫ জন্য নির্ধারিত বার্ষিক মানমাত্রাপ্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর পরিমাণ দেখে তালিকাটি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ বায়ু দূষণের ফলে মারা যায়।
স্টামফোর্ডইউনিভার্সিটির ‘বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)’ ২০১৯ সালে ভূমি ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে ঢাকা শহরের ৭০টি স্থানের বায়ুর মান পর্যবেক্ষেণের লক্ষ্যে বায়ুতে বস্তুকণা১, বস্তুকণা ২.৫ ও বস্তুকণা ১০ এর উপস্থিতির পরিমাণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। উক্ত গবেষণার অংশ হিসেবে ঢাকা শহরের ১০টি সংবেদনশীল, ২০টি আবাসিক, ১৫টি বাণিজ্যিক, ২০টি মিশ্র এবং ৫টি শিল্প এলাকার বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করা হয়। এই বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ১১ সদস্যের একটি গবেষক দল কাজ করেন এবং দলের প্রধান ছিলেন ‘ক্যাপস’ এর পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
ঢাকার সংবেদনশীল এলাকার মধ্যে বস্তুকণা ২.৫ দ্বারা সবচেয়ে দূষিত ৩টি এলাকা হল যথাক্রমে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৮৪ মাইক্রোগ্রাম), ধানমন্ডি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৬ মাইক্রোগ্রাম) ও বাংলাদেশ সচিবালয় এলাকায় (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬০ মাইক্রোগ্রাম)। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের ৫ নং গেটে (প্রতি ঘনমিটারে ১৭৩ মাইক্রোগ্রাম) এবং উত্তরার শাহজালাল এভিনিউ এলাকায় (প্রতি ঘনমিটারে ২৩৬ মাইক্রোগ্রাম) তুলনামূলকভাবে দূষণের মাত্রা কম ছিল। সামগ্রিকভাবে ১০টি সংবেদনশীল এলাকায় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৯৪ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শ মানমাত্রার প্রায় ৪ দশমিক ৫ গুণ বেশি।
২০টি আবাসিক এলাকার মধ্যে বস্তুকণা২.৫দ্বারা সবচেয়ে দূষিত ৩টি এলাকা হল- রাজা শ্রীনাথ স্ট্রীট, লালবাগ (প্রতি ঘনমিটারে ৫০৭ মাইক্রোগ্রাম), মনিপুরি পাড়া, মিরপুর (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৮ মাইক্রোগ্রাম) ও ধলপুর আবাসিক, যাত্রাবাড়ী (প্রতি ঘনমিটারে ৩০৭ মাইক্রোগ্রাম)।গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন মানিকদি এলাকায় (প্রতি ঘনমিটারে ২১৪ মাইক্রোগ্রাম) এবং গুলশানের ১০১ নং রোডে (প্রতি ঘনমিটারে ২১৫ মাইক্রোগ্রাম) তুলনামূলকভাবে দূষণের মাত্রা কম ছিল। সামগ্রিকভাবে ২০টি আবাসিক এলাকায় বস্তুকণা২.৫ এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৯০ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শ মানমাত্রার ৪ দশমিক ৫ গুণ বেশি।
১৫টি বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে বস্তুকণা২.৫দ্বারা সবচেয়ে ৩টি দূষিত এলাকা হল- ডি.আই.টি উলন রোড মোড়, রামপুরা (প্রতি ঘনমিটারে ৪৪৯ মাইক্রোগ্রাম), ইসলামপুর, পুরান ঢাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৪৩৫ মাইক্রোগ্রাম) ও পল্টন মোড় (প্রতি ঘনমিটারে ৩৫৪ মাইক্রো গ্রাম)। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, ভি.আই.পি রোড, বাংলা মোটরে (প্রতি ঘনমিটারে ২০২ মাইক্রোগ্রাম) ও জসিমউদ্দিন এভিনিউ, উত্তরায় (প্রতি ঘনমিটারে ২২৭ মাইক্রোগ্রাম) তুলনামূলকভাবে দূষণের মাত্রা কম ছিল। সামগ্রিকভাবে ১৫টি বাণিজ্যিক এলাকায় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩০৮ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শ মানমাত্রার ৪ দশমিক ৭ গুণ বেশি।
মিশ্র এলাকা: ২০টি মিশ্র এলাকার মধ্যে বস্তুকণা ২ দশমিক ৫দ্বারা সবচেয়ে ৩টি দূষিত এলাকা হল- ফার্মগেট পুলিশ বক্সের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৯ মাইক্রোগ্রাম), ইংলিশ রোড, বংশাল (প্রতি ঘনমিটারে ৩৬৫ মাইক্রোগ্রাম) ও নয়াপল্টন জামে মসজিদের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৩৪৩ মাইক্রোগ্রাম)। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, নিউ মার্কেট মেইন গেটের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ১৫১ মাইক্রোগ্রাম) এবং বড় মগবাজারে (প্রতি ঘনমিটারে ২২২ মাইক্রোগ্রাম) তুলনামূলকভাবে দূষণের মাত্রা কম ছিল। সামগ্রিকভাবে ২০টি মিশ্র এলাকায় বস্তুকণা২.৫ এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২৯৩ মাইক্রো গ্রাম, যা আদর্শ মানমাত্রার ৪ দশমিক ৫ গুণ বেশি।
শিল্প এলাকা: ৫টি শিল্প এলাকার মধ্যে বস্তুকণা২ দশমিক ৫দ্বারা সবচেয়ে দূষিত এলাকা হল- ট্যানারি মোড় জামে মসজিদের সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ৪৩৬ মাইক্রোগ্রাম)।গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, সিরামিক রোড, পল্লবী এর সামনে (প্রতি ঘনমিটারে ২৩০ মাইক্রোগ্রাম) তুলনামূলকভাবে দূষণের মাত্রা কম ছিল। সামগ্রিকভাবে পাঁচটা শিল্প এলাকায় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর গড় মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৩৩৬ মাইক্রোগ্রাম, যা আদর্শ মানমাত্রার ৫ দশমিক ১ গুণ বেশি।
গবেষকরা জানান, সবচেয়ে দূষিত হল শিল্প এলাকা সমূহ এর পরেই রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকা সমূহ এবং সবচেয়ে কম দূষিত হল আবাসিক এলাকা সমূহ। গবেষণায় দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের বায়ুতে গড়ে বস্তুকণা ১০ এর মধ্যে প্রায় ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ বস্তুকণা২.৫এবং ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ বস্তুকণা১ এর উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও বস্তুকণা২ দশমিক ৫ এর মধ্যে প্রায় ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ বস্তুকণা১ এর উপস্থিতি রয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা২.৫ এর পরিমাণ বেশি। এটি সাধারণ জীবাশ্মজ্বালানি পোড়ানো থেকে আসে। অর্থাৎ যানবাহন, শিল্পকারখানা ও বর্জ্য পোড়ানোথেকেযে ধোঁয়া বের হয়, তা থেকে আসে।
প্রাপ্ত ফলাফল এর উপর ভিত্তি করে জি আই এস মানচিত্রের সাহায্যে ঢাকা শহরকে চারটি জোনে ভাগ করা যায়। কোন কোন স্থানে দূষণ অনেক বেশি আবার অনেক স্থানে দূষণ অনেক কম। উক্ত গবেষণা হতে দেখা যায় যে, বায়ু দূষণের মাত্রা নতুন ঢাকা হতে পুরাতন ঢাকায় তুলনামূলক অনেক বেশি। পুরাতন ঢাকার লালবাগ, সূত্রাপুর, কামরাঙ্গিরচর ও কোতোয়ালিতে বস্তুকণা দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এর পরেই তেজগাঁও শিল্প এলাকা, বাড্ডা- রামপুরা ও মিরপুর এলাকায় দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। প্রাপ্ত মানচিত্র হতে দেখা যায়, পল্লবী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বায়ু দূষণের মান তুলনামূলক কম রয়েছে।
গবেষণায় বায়ুদূষণ রোধে ১৪ দফা সুপারিশমালা করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে – বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সবার আগে সবাইকে মিলে সমন্বিত ভাবে কাজ করা, ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষার জন্য উন্নত মাস্ক ব্যবহার করা, শিশু, অসুস্থ এবং গর্ভবতী নারীদের সাবধানতা অবলম্বন করে চলা। এছাড়া, ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের নির্দেশনা দেয়া, আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসাবে হলো ব্লক এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো, নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা, নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নের জন্য উন্নত প্রযুক্তির “ইনসিনারেটর” এর ব্যবহার শুরু করতে হবে যাতে বর্জ্য হতে শক্তি উৎপাদন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে, দিনে অন্তত দুই বেলা সকালে ও বিকালে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটানো, এছাড়াও সরকারের সিটি কর্পোরেশন হতে একটি অনুরোধ মূলক নির্দেশনা জারি করে প্রত্যেক ভবন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন তারা নিজ উদ্যোগে প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর তাদের ভবনের সামনের রাস্তায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেন। আর এই কাজে তারা এসি হতে সৃষ্ট পানি ব্যবহার করতে পারেন, রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা, যত দ্রুত সম্ভব নির্মল বায়ু আইন ২০১৯ বাস্তবায়ন করা, সিটি গভর্নেন্স এর প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়ন মূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করা, জলাধার সংরক্ষণ করা, প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
তাছাড়া, নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষন স্টেশন (ক্যামস) এর ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে করা, বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করা, লোকবল সঙ্কট নিরসনে প্রত্যেক উপজেলায় একজন পরিবেশ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া এবং এটি নিশ্চিত করার জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিসিএস)-এ পরিবেশ ক্যাডার অন্তর্ভুক্ত করা, সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২০ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা