ফজলুল বারী : খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন হাইকোর্টে আবার খারিজ হয়েছে। এবার এই আবেদন খারিজ করতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চকে খুব বেগ পেতে হয়নি। ডাক্তারদের ওপর ডাক্তারি করতে গেছেন খালেদা জিয়া! তাঁর আইনজীবীরাও একই কান্ড করেছেন! অথচ একজন রোগিনীকে চিকিৎসা দেবেন চিকিৎসকরাই। আইনজীবী বা হাইকোর্টের বিচারকরা নন। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ কোর্টকে বলেছিলেন খালেদা জিয়া কেনো উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিতে রাজি হচ্ছেননা এটা জানতে তারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। কোর্ট তখন তাঁকে বলেন, আপনি গিয়ে কী করবেন? আপনি ডাক্তার নাকি? এবার জামিনের চেষ্টা করতে গিয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বোনাস কিছু শক্ত কাঠখোট্টা কথাও শুনেছেন। কোর্ট তাদেরকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, খালেদা একজন দন্ডিত বন্দিনী। সাধারন মানুষ কোর্টের কাছে যা পাবে একজন দন্ডিত বন্দিনী তা পাবেনা। জেলকোড অনুসারে তিনি চিকিৎসা পাবেন।
এ নিয়ে উচ্চ আদালতে তৃতীয়বার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হলো বিএনপির চেয়ারপার্সনের। হাইকোর্টে দু’বার, আপিল বিভাগে একবার। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের যে বেঞ্চে জামিন প্রত্যাখ্যাত হলো, একই বেঞ্চে আগেও জামিন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আপিল বিভাগে জামিন প্রত্যাখ্যাত হবার সময় যে পর্যবেক্ষন দেয়া হয়েছিল সেই পর্যবেক্ষনই ছিল এবার কোর্টের বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গি। আপিল বিভাগ বলেছিল খালেদা জিয়া রাজি হলে যাতে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের আদালতে জমা রিপোর্টে বলা হয়, খালেদা জিয়া অনুমতি না দেয়ায় তাঁর উন্নত চিকিৎসা শুরু করা যায়নি। আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেছেন, উন্নত চিকিৎসার অনুমতি দিলে এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপার্সনের জীবন বিপন্ন হতে পারে। সে কারনে তিনি তাতে সম্মতি দেননি। আবার বলা হয়, যুক্তরাজ্যের যে হাসপাতালে খালেদা জিয়ার আর্থাইটিজের চিকিৎসা হয়েছিল, সেখানেই তারা উন্নত চিকিৎসা নিতে চান।
এবারের জামিনের আবেদনে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের প্রস্তুতির অভাবের পাশাপাশি কিছুটা স্ববিরোধিতাও ছিল। আপিল বিভাগে যখন আদেশ দিতে দেরি করা হচ্ছিল তখন আদালত কক্ষে নজিরবিহীন হট্টগোলের পাশাপাশি বিএনপির আইনজীবীদের পক্ষে বলা হচ্ছিল এই সময়ে যদি খালেদার কিছু ঘটে যায় এর দায় কে নেবে! আর বৃহস্পতিবার আইনজীবীরা পীড়াপীড়ি করছিলেন আদেশটি যাতে এখনই না দিয়ে রবিবারে দেয়া হয়! কি স্পষ্ট স্ববিরোধিতা! খালেদা জিয়া অসুস্থ এ নিয়ে কারও কোন দ্বিমত নেই। একজন অসুস্থ মানুষ সুস্থ হবার জন্যে চিকিৎসকরা যে চিকিৎসা দিতে চান তা অবশ্যই গ্রহন করেন। আর খালেদা জিয়াতো দেশের আমজনতা কেউ নন। দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসালয়ে একটি ভিভিআইপি কেবিনে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত। আর খালেদা জিয়া সেই চিকিৎসকদের দেখাই দিতে চাননা! রাউন্ডে বেরিয়ে চিকিৎসকরা তাঁর কেবিনের দরজায় এসে ধর্না দেন। খালেদা জিয়া তাদের কেবিনে প্রবেশাধিকার দেননা! আর তাঁর বোন মিডিয়াকে বলেন, ওই হাসপাতালে খালেদাকে কোন চিকিৎসাই দেয়া হচ্ছেনা! বৃহস্পতিবার এই রিপোর্ট বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে শুনতে গিয়ে একটি প্রবনতায় চমকে যেতে হয়! বাংলাদেশের বিশেষ কিছু লোক ব্রাহ্মনবাড়িয়াকে বি বাড়িয়া, নারায়নগঞ্জকে এন গঞ্জ বলেন! এই রিপোর্টগুলোতেও হাসপাতালের নাম বলা হচ্ছিল বিএসএমএম! বঙ্গবন্ধু বলতে যারা সূচিবায়ুগ্রস্ত তারাই কী নামটি চালু করছেন?
খালেদার চিকিৎসা, জামিনের রিপোর্ট লিখতে লিখতে একটি গল্প মনে পড়ে যায়। এক পরীক্ষার্থী দেখলো, পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। কিন্তু তার প্রস্তুতি ভালো হয়নি। তখন সে পরীক্ষা এড়াতে অসুস্থ হবার চেষ্টা করে! দিনে রাতে ১০-১২ বার গোসল করে সে ঠান্ডা লাগানোর চেষ্টা করে! যাতে বাবা-মা অন্তত বলবে, অসুস্থ অবস্থায় পরীক্ষা দেবার দরকার নেই অথবা অসুস্থ অবস্থায় তার পরীক্ষা খারাপ হতেই পারে! খালেদা জিয়া চিকিৎসা না নিয়ে যে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! তাঁর এখন যে বয়স, এ অবস্থায় স্থায়ী রূপ নিতে পারে পঙ্গুত্ব। এটা দেখেশুনেও তিনি কী মনে করছেন তাঁর এই শারীরিক অবস্থা দেখে তাকে জামিন দেয়া হবে বা বিদেশে চিকিৎসার জন্যে যেতে দেয়া হবে! বাংলাদেশে সেই রাজনৈতিক কালচার কী খালেদা জিয়াও ক্ষমতায় থাকতে মনে রেখেছেন? গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত শাহ এস এম কিবরিয়াকে ঢাকা আনতে যদি হেলিকপ্টার দেয়া হতো তাহলে তাঁকে হয়তো বাঁচানো যেত। কিন্তু সেটি দেয়া হয়নি। এবার আবার কোর্ট যে সত্য মনে করিয়ে দিয়ে বললো, খালেদা একজন দন্ডিত বন্দিনী। সাধারন মানুষ কোর্টের কাছে যা পাবে একজন দন্ডিত বন্দিনী তা পাবেনা। জেলকোড অনুসারে তিনি চিকিৎসা পাবেন।‘ খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের এখন আদালতের ভিতরে বাইরে এ কথাটি শুনতে হবে বারবার।
কিন্তু খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দরকার। ডাক্তারদের ওপর ডাক্তারি করতে গিয়ে তিনি নিজেই বিষয়টিকে জটিল করেছেন। এটি অবশ্য খালেদার চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেশের তথ্য বিদেশে চলে যেতে পারে এই দুশ্চিন্তায় তিনি সাবমেরিন কেবলের সংযোগ নিতে রাজি হননি! এখন কী ইন্টারনেট ছাড়া বাংলাদেশের চলে? বিএনপির চলে? সেই সাবমেরিন ক্যাবলের সংযোগ পেতে বাংলাদেশকে পরে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ডাক্তারদের ওপর ডাক্তারি করতে গিয়ে খালেদা জিয়াও চরম মূল্য দিচ্ছেন এবং দেবেন। কিন্তু তাঁর পারিবারিক রাজনৈতিক দোকানের কর্মচারীরা এরসঙ্গে যেভাবে গলা মেলাচ্ছেন এর ফলাফল ক্ষতিকর ও হাস্যকর হতে বাধ্য। ডাক্তারের কাজ আইনজীবীদের কাজ এক নয়। একজন রোগীর শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট দিতে পারেন ডাক্তাররা। কোর্ট সেটিকেও আমল দিয়ে বলে দিয়েছে বিএনপি হাঁটছে ভুলপথে। বিএনপির সাম্প্রতিক কোনঠাসা আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যটি আবার স্পষ্ট হলো। মাহবুব হোসেন বলেছিলেন আইনি পথে খালেদার মুক্তি হবেনা। যেভাবে মুক্তি হবে সেভাবে মুক্তি নিয়ে দরকার খালেদা জিয়ার চিকিৎসা। সে পথটি হলো প্যারোল।
পরবর্তী মন্তব্যের জন্য আপনার নাম,ইমেইল,ওয়েবসাইট ব্রাউজারে সংরক্ষণ করুণ
সম্পাদকঃ
বিডিবিএল ভবন ( লেভেল - ৮) ১২ কারওয়ান বাজার সি/এ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
কপিরাইট © ২০২৪ পাওয়ার্ড বাই লালসবুজের কথা